সন্তানের পরিচর্যা ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ

সন্তান মানবজীবনের সৌন্দর্য। সুসন্তান পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সম্পদ। সন্তানের চোখে ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখেন মা-বাবা। আদর্শ সন্তানের মাধ্যমে দুনিয়া ও আখিরাতে সম্মান বাড়ে তাদের। মৃত্যুর পরও তার সুফল পেতে থাকেন অনন্তকাল। পবিত্র কোরআনে সন্তানকে আল্লাহতায়ালা জীবনের সৌন্দর্য হিসেবে উল্লেখ করেছেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘সম্পদ ও সন্তান পার্থিব জীবনের সৌন্দর্য।’ (সুরা কাহাফ, আয়াত : ৪৬)

সন্তান যেন জীবনের সম্পদ ও শোভা হয়ে ওঠে এজন্য ইসলাম মা-বাবাকেও বহু নির্দেশনা দিয়েছে। এর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ পাঁচটি নির্দেশনা তুলে ধরা হলো

আদর্শ মা
আরেকটি শৈত্যপ্রবাহের কবলে পড়তে যাচ্ছে দেশ, তাপমাত্রা কমছে ১ থেকে ৩ ডিগ্রি ≣ [১] মিরসরাইয়ে ৬হাজার দরিদ্র পরিবারের সাহায্যে হাত বাড়িয়ে দিলেন সাবেক মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন ≣ [১] শিবচর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান শ্বাসকষ্ট নিয়ে মারা গেলেন

সুসন্তান লাভের প্রথম ও প্রধান শর্ত হলো সন্তানের জন্য আদর্শ মা নির্বাচন করা। অর্থাৎ এমন নারীকে বিয়ে করা, যে সন্তানের আদর্শ মা হতে পারবে। হাদিসে বিয়ের আগে পাত্রীর চারটি গুণাগুণ দেখতে বলা হয়েছে। রাসুল (সা.) বলেন, ‘পাত্রীর চারটি গুণ দেখে বিয়ে করো তার সম্পদ, তার বংশমর্যাদা, তার রূপ-সৌন্দর্য ও তার দ্বীনদারি। তবে তুমি দ্বীনদারিকে প্রাধান্য দেবে। নতুবা তুমি ক্ষতিগ্রস্ত হবে।’ (বুখারি, হাদিস : ৫০৯০)

হাদিসে দ্বীনদারিকে প্রাধান্য দিতে বলা হয়েছে। দ্বীনদারি অর্থ শুধু ইবাদত পালন নয়। এর অর্থ হলো, আল্লাহর সব বিধান মান্য করে চলা। স্ত্রী হিসেবে, ঘরের বউ হিসেবে, সন্তানের মা হিসেবে তার করণীয়গুলো পালন করা।

সুসন্তান কামনা

সন্তান আল্লাহর দান। আল্লাহ কাউকে সন্তান দান করেন; আবার কাউকে দান করেন না। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘তিনি যাকে ইচ্ছা কন্যাসন্তান দেন, যাকে ইচ্ছা পুত্রসন্তান দেন। আবার কাউকে কন্যা ও পুত্রসন্তান উভয়টি দেন। যাকে ইচ্ছা তিনি বন্ধ্যা করেন। নিশ্চয়ই তিনি সবকিছু জানেন এবং সবকিছুতে সক্ষম।’ (সুরা আশ-শুরা, আয়াত : ৫০)

আর সুসন্তান আল্লাহর অনেক বড় অনুগ্রহ। এই অনুগ্রহ লাভের জন্য আল্লাহর দরবারে প্রার্থনা করা আবশ্যক। আল্লাহ কোরআনে মানুষকে সুসন্তান লাভের দোয়া শিখিয়েছেন। এই দোয়াকারী মা-বাবার প্রশংসা করে তিনি বলেছেন, ‘এবং যারা বলে, হে আমাদের প্রভু, আমাদের দান করুন চোখ শীতলকারী স্ত্রী ও সন্তান। আমাদের আপনি খোদাভীরুদের নেতা নির্বাচন করুন।’ (সুরা ফোরকান, আয়াত : ৭৪)

বৈষম্যহীনতা

সন্তান ছেলে হোক বা মেয়ে তার জন্মে আনন্দ প্রকাশ করা মা-বাবার জন্য ইমানের পরিচায়ক। আল্লাহতায়ালা ছেলে ও মেয়ে উভয়ের জন্মকে কোরআনে সুসংবাদ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। ইয়াহইয়া (আ.) সম্পর্কে কোরআনে বলা হয়েছে, ‘হে জাকারিয়া, নিশ্চয়ই আমি তোমাকে পুত্রসন্তানের সুসংবাদ দিচ্ছি। তার নাম ইয়াহইয়া। এই নাম আগে কারও রাখা হয়নি।’ (সুরা মারিয়াম, আয়াত : ৭)

ছেলে জন্মের খবর যেমন আল্লাহর পক্ষ থেকে সুসংবাদ, মেয়ে জন্মের সংবাদও আল্লাহর পক্ষ থেকে সুসংবাদ। যারা এই সুসংবাদে সন্তুষ্ট হতে পারে না, আল্লাহ তাদের কঠোর সমালোচনা করেছেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘যখন তাদের কন্যাসন্তানের সুসংবাদ দেওয়া হয়, মনঃকষ্টে তাদের চেহারা কালো হয়ে যায়। তাদের যে সুসংবাদ দেওয়া হয়েছে তার কারণে তারা নিজ সম্প্রদায়ের লোক থেকে মুখ লুকিয়ে রাখে। তারা ভাবে, এই সন্তান রাখবে, নাকি মাটিতে পুঁতে ফেলবে। খবরদার! তাদের সিদ্ধান্ত কতই না নিকৃষ্ট। (সুরা নাহল, আয়াত : ৫৮-৫৯)

অন্য আয়াতে আল্লাহ কন্যাসন্তানের মা-বাবাকে এই সান্ত¡না দিয়ে বলেছেন, ‘অনেক পুরুষ নারীর সমকক্ষ নয়।’ (সুরা মারিয়াম, আয়াত : ৩৬) অর্থাৎ তোমাদের যে কন্যাসন্তান দান করা হয়েছে, তা অনেক পুরুষের তুলনায় উত্তম হতে পারে। অনেক পুরুষ অনেক নারীর তুলনায় অধমও হয়। রাসুল (সা.) ছেলেমেয়ে-নির্বিশেষে সবার প্রতি ন্যায়ানুগ আচরণ করতে বলেছেন। তিনি বলেন, ‘আল্লাহকে ভয় করো, সন্তানদের ভেতর সুবিচার করো।’ (বুখারি, হাদিস : ২৫৮৭)

সুন্দর ও অর্থবহ নাম

সুন্দর ও অর্থবহ নাম সন্তানের প্রথম অধিকার। রাসুল (সা.) সন্তান জন্মের সাত দিনের ভেতর তার নাম রাখার নির্দেশ দিয়েছেন। সন্তানের নাম সুন্দর ও অর্থবহ হওয়া আবশ্যক। ইসলাম গ্রহণের পর অনেক সাহাবির নাম রাসুল (সা.) পরিবর্তন করে দিয়েছিলেন। কেননা তাদের নাম ইসলামি ভাবাদর্শের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ছিল অথবা তাদের নাম অর্থপূর্ণ ছিল না। জয়নব (রা.)-এর নাম ‘বাররাহ’ পরিবর্তন করে জয়নব রাখেন। (বুখারি, হাদিস : ৬১৯২)

সন্তানের নাম রাখার ব্যাপারে রাসুল (সা.) বলেন, ‘কিয়ামতের দিন তোমাদের নামে এবং তোমাদের পিতাদের নামে ডাকা হবে। সুতরাং তোমরা সুন্দর নাম রাখো।’ (আবি দাউদ, হাদিস : ৪৯৪৮)

একইভাবে তিনি অর্থহীন, শ্রুতিকটু ও মন্দ অর্থের নাম রাখতে নিষেধ করেছেন। মহানবী (সা.) বলেন, ‘তোমরা তোমাদের ছেলেদের নাম ইয়াসার, রাবাহ, নাজাহ ও আফলাহ রেখো না।’ (মুসলিম, হাদিস : ২১৩৬)

লালন-পালন

শিক্ষা-দীক্ষা, পারিবারিক প্রতিপালন ও পারিপার্শ্বিকতা শিশুর ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করে। তাই সন্তান প্রতিপালনে মা-বাবা ও অভিভাবকদের অনেক বেশি যতœশীল হতে হবে। সন্তানের সুশিক্ষা নিশ্চিত করতে পারলেই ভবিষ্যতে সে আদর্শ মানুষ হয়ে উঠবে। পরিবার, দেশ ও জাতির সম্পদে পরিণত হবে। ইসলাম শিশুর প্রতিপালনে কয়েকটি বিষয় লক্ষ রাখতে ও নিশ্চিত করতে বলেছে। তা হলো ক. ইমানি শিক্ষা। খ. চারিত্রিক শিক্ষা। গ. বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ। ঘ. শারীরিক সুস্থতা ও প্রবৃদ্ধি। ঙ. মানসিক স্বাস্থ্যের সুরক্ষা। চ. সামাজিক শিক্ষা তথা সামাজিকীকরণ।

ইমানি শিক্ষা

এর অর্থ হলো, ইসলামের মৌলিক আকিদা ও বিশ্বাস, ইবাদত ও আমল, হালাল ও হারাম, আল্লাহর পছন্দনীয়-অপছন্দীয় কাজ সম্পর্কে শিক্ষা দেওয়া। এই পরিমাণ দ্বীনি শিক্ষা নিশ্চিত করা মা-বাবার আবশ্যিক কর্তব্য। মা-বাবা তা করতে ব্যর্থ হলে পরিণত বয়সে ব্যক্তির জন্য তা অর্জন করা ফরজ।

চারিত্রিক শিক্ষা

শৈশব থেকে ভালো-মন্দের পার্থক্য শেখাতে হবে। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, মানুষের সেবা, সময়ানুবর্তিতা, পরিমিতিবোধ ও অল্পতুষ্টির উপকার বোঝাতে হবে। একই সঙ্গে অপরিচ্ছন্নতা, মানুষ ও পশু-পাখিকে কষ্ট দেওয়া, অন্যের ক্ষতি করা, কারও জিনিস অনুমতি ছাড়া ব্যবহার করার মতো মন্দ স্বভাবগুলো সম্পর্কে সচেতন করাও জরুরি।

বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ

শিশুকে শৈশব থেকে ধর্মীয় জ্ঞান ও সাহিত্যপাঠে অভ্যস্ত করা। বুদ্ধির বিকাশে সহায়ক খেলনা ও জ্ঞানচর্চার উপকরণের ব্যবস্থা করা। ইতিহাসসচেতন করতে ঐতিহাসিক স্থাপনা ও জাদুঘর পরিদর্শনে নিয়ে যাওয়া। অর্থহীন গল্প না করে পূর্ববর্তী জ্ঞানী, বিজ্ঞানী ও ইতিহাসের মহানায়কদের বৃত্তান্ত শোনানো। কোরআন-হাদিসে বর্ণিত গল্প ও ইতিহাস, ইসলামের স্বর্ণযুগের মনীষীদের জীবনচরিত ও জ্ঞান সাধনা, আল্লাহর পথে তাদের ত্যাগ ও আত্মবিসর্জনের বিবরণ শিশুর বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশে সহায়ক হতে পারে।

শারীরিক সুস্থতা

শিশুর শারীরিক সুস্থতা ও বিকাশ নিশ্চিত করতে ইসলাম প্রথমে মায়ের দুধে তার অধিকার নিশ্চিত করতে বলেছে। কোরআনে শিশুর মাতৃদুগ্ধ পানের বিধান বিস্তারিতভাবে এসেছে। সুরা বাকারার ২৩৩ নম্বর আয়াতে শিশুর দুধপানের সময়কাল, মা-বাবার কর্তব্য, মা-বাবার মধ্যে বিচ্ছেদ হলে সে ক্ষেত্রে করণীয় বিষয়ে আল্লাহতায়ালা পৃথক নির্দেশনা দিয়েছেন। দুধপানের সময় অতিবাহিত হওয়ার পর বাবাকে সন্তানের জন্য উদারভাবে খরচ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। পরিবারের জন্য ব্যয়কৃত অর্থকে আল্লাহর পথে ব্যয়িত অর্থের মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি ইসলাম শিশুর শারীরিক বিকাশ নিশ্চিতে উপকারী খেলাধুলা ও বৈধ বিনোদনে উৎসাহিত করেছে। রাসুল (সা.)-ও হাসান-হোসাইন (রা.)-এর সঙ্গে খেলাধুলা করতেন।

মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষা

শিশুর মানসিক বিকাশে ইসলাম শিশুর সঙ্গে দুর্ব্যবহার করতে নিষেধ করেছে। শিশুর সামনে ঝগড়া-বিবাদ করতে এবং তাদের সঙ্গে মিথ্যা বলতে ও প্রতারণা করতে বারণ করেছে। ইসলাম উদীয়মান শিশুর সামনে স্বামী-স্ত্রীসুলভ আচরণ করতেও নিষেধ করেছে। আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো শিশুকে বলল, এসো আমি তোমাকে (কোনো কিছু) দেব, অতঃপর সে যদি না দেয়, তবে এটা মিথ্যা বলা হবে।’ (আবি দাউদ, হাদিস : ৪৯৯১)

সামাজিকীকরণ

শিশুর সামাজিকীকরণে ইসলাম প্রথমেই যৌথ পরিবারে উদ্বুদ্ধ করে। এরপর শিশুকে সামাজিক আয়োজনে অংশগ্রহণের সুযোগ করে দিতে বলে। বোধসম্পন্ন শিশুকে মসজিদে, ঈদগাহে সঙ্গে করে নিয়ে যেতেও বলা হয়েছে।

সমাজের সবার প্রতি ইসলামের নির্দেশ হলো, শিশুর প্রতি সুন্দর আচরণ করতে হবে, যেন সে সুন্দর আচরণ শিখতে পারে। রাসুল (সা.) বলেন, ‘যারা বড়কে সম্মান করে না এবং ছোটকে স্নেহ করে না, সে আমাদের দলভুক্ত নয়।’ (তিরমিজি, হাদিস : ১৯২১)

0Shares

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *