রাবানে প্রতিটি বাড়িই যেন আনারসের বাগান

ক্ষেত থেকে তুলে আনা আনারস। ছবি: বাংলানিউজ

নরসিংদী: দেশের অনেক জায়গায় আনারসের চাষ হলেও সারাদেশে রাবানের আনারসের আলাদা খ্যাতি রয়েছে। সেই সুবাদে রাবানের সুস্বাদু আনারসের দাম ও চাহিদা দুটিই বেশ চড়া।

রাজধানী ঢাকার পাশ্ববর্তী জেলা নরসিংদীর পলাশ উপজেলার প্রাচীন গ্রাম ‘রাবান’। এই গ্রামের পূর্ব পাশ দিয়ে বয়ে গেছে প্রাচীন ব্রহ্মপুত্র নদ। আর পশ্চিম দিকে প্রবহমান শীতলক্ষ্যা। টিলা-টেকর আর গাছগাছালিতে ঘেরা গ্রামটি ছবির মতো সুন্দর। এই গ্রামের প্রতিটি বাড়িই যেন ফলের বাগান।

জানা যায়, দেশে সর্বপ্রথম বাণিজ্যিকভাবে আনারসের চাষাবাদ শুরু হয়েছিল এই গ্রাম থেকে। পরবর্তীকালে তা আশপাশের গ্রামগুলোতে ছড়িয়ে পড়ে, যা দেশব্যাপী ‘ঘোড়াশাল আনারস’ নামে খ্যাতি পায়। মূলত এই ঘোড়াশাল আনারসের গোড়াপত্তন হয়েছিল রাবানের আনারস থেকে। অতীতে রাবান ও আশপাশের গ্রামগুলোতে ‘ডোয়াই’ নামের একটি উপজাতির বাস ছিল। তাদের হাতেই রাবান ব্যান্ড খ্যাত আনারসের চাষাবাদ শুরু হয়েছিল।

আনারস, কাঁঠাল, পেয়ারা, লটকন প্রভৃতির পাশাপাশি তারা বাঁশ ও বেত দিয়ে বিভিন্ন পণ্য তৈরি করে বিক্রি করত। ১৩৪৩ বঙ্গাব্দে প্রকাশিত ‘ঘোড়াশাল কাহিনী’ ইতিহাস গ্রন্থে এসব তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে।

গাছে ধরে রয়েছে আনারস। ছবি: বাংলানিউজকৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, রাবানের মাটির ধরন, পরিবেশ এবং ফল গাছে প্রয়োগ করা জৈব সারের বৈশিষ্ট্যের কারণেই এখানকার আনারসের স্বাদ বেশি হয়ে থাকে। শত শত বছর ধরে এই গ্রামে চাষকৃত আনারস মূলত হানিকুইন নামের একটি জাত থেকে সৃষ্টি হয়েছে। তবে এ জাতের চেয়েও এখানকার মাটির গুণই বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। একটু উঁচু জমিতে আনারসের চাষ করা হয়। এলাকাটি একটু উঁচু হওয়ায় অতিবৃষ্টি কিংবা বন্যা পৌঁছাতে পারে না। সর্বত্র গাছগাছালি থাকায় খরাও কোনো ক্ষতি করতে পারে না।

পলাশ উপজেলার জিনারদী ইউনিয়নের রাবান, বরাব, সাতটেকিয়া, কুড়াইতলীসহ আরো কয়েকটি গ্রামে আনারসের চাষ হয়ে থাকে। চলতি বছর রাবানে ১৪৫ হেক্টর জমিতে আনারস চাষ করা হয়েছে। যা গত বছরের তুলনায় ৩ হেক্টর বেশি। প্রতি হেক্টরে ১২ টন আনারসের ফলন হয়েছে। রাবানে চলতি বছর ১ হাজার ৭৪০ মেট্রিক টন আনারসের ফলন হয়েছে।

বাজারে রাবানের আনারসের চাহিদা থাকায় এবং লাভ বেশি হওয়ায় চাষের পরিধিও বেড়েছে। রাবানে প্রায় পাঁচ শতাধিত চাষি আনারস চাষ করে থাকেন।

আনারস চাষি সুশীল দত্ত বলেন, এবার আমি আধাবিঘা জমিতে আনারস চাষ করেছি। আনারসের ফলনও ভালো হয়েছে। বাজারে দামও ভালো পাচ্ছি। বাজারে প্রতিটি আনারস আকার ভেদে ২০ টাকা থেকে ৫০ টাকায় বিক্রি করছি।

আরেক কৃষক সুনীল দাস বলেন, আনারস চাষে তেমন শ্রম দিতে হয় না। খরচের তুলনায় লাভ বেশি পাওয়া যায়। প্রতি পিস আনারস ১৫ থেকে ২৫ টাকায় জমি থেকেই কিনে নিয়ে যান পাইকারি ব্যবসায়ীরা।

ক্ষেত থেকে আনারস তুলছেন চাষি। ছবি: বাংলানিউজস্থানীয় কৃষক হিমানশু দাস বলেন, প্রায় দুশ বছর আগে থেকে আমাদের পূর্বপুরুষরা গ্রামে আনারস, কাঁঠাল, পেয়ারাসহ বিভিন্ন ফলের চাষ করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। আমরাও বংশপরম্পরায় আজও সেটা করে যাচ্ছি। আমাদের গ্রামের মাটি লাল এবং অনেক প্রাচীন। তাই বাড়ির আঙিনা, পতিত জমি ও বিভিন্ন ফলের বাগানের জমিতেও বাণিজ্যিকভাবে চাষ করা হচ্ছে হানিকুইন জাতের আনারস। বিয়ানীবাজার থেকে আনা জলঢুপ গ্রামের বিশেষ জাতের আনারসও এখানে চাষাবাদ শুরু হয়েছে। এই জলঢুপ আনারসও হানিকুইন জাত থেকেই সৃষ্ট।

আনারস পচনশীল ফল হওয়া সত্বেও এর কোনো সংরক্ষণ ব্যবস্থা নেই। সংরক্ষণ করতে পারলে আরও লাভ হতো। এ জন্য একটি হিমাগারের প্রয়োজন। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কৃষকদের আনারস সংরক্ষণের জন্য একটি হিমাগার স্থাপন করে দিলে বড় উপকার হতো।

আর আনারস হচ্ছে ঔষধি গুণসম্পন্ন ফল। শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিতে আনারস গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। আনারসের জুসে আলাদা করে চিনি দিতে হয় না। আনারসে থাকা অ্যাসকরবিক অ্যাসিড শরীরে ভিটামিন সির চাহিদা পূরণ করে, যা সংক্রমণ রোগ প্রতিরোধে খুব প্রয়োজন। আনারস জ্বর-ঠাণ্ডা সারাতেও খুবই উপকারী।

এছাড়া হার্ট ভালো রাখে, ক্ষত সারাতে, হজম ক্ষমতা বৃদ্ধি ও পেশির ব্যথাসহ রক্তকে হঠাৎ করে জমাট বাঁধতে দেয় না।

পলাশ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আমিরুল ইসলাম বলেন, রাবানের মাটি তুলনামূলক উঁচু হওয়ায় সেখানে জন্মানো ফলমূল অন্যান্য এলাকা থেকে একটু বেশি সুস্বাদু হয়ে থাকে। উপজেলা কৃষি অফিসের কর্মকর্তারা আনারস চাষিদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে বিভিন্ন পরামর্শ দিয়ে থাকেন। আনারসের ফলন যাতে বৃদ্ধি পায় সেজন্য কৃষকদের সময়মত সুষম সার, খরায় পানির সেচ ও বাগান পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে পরামর্শ দেওয়া হয়। এজন্য মাটির পাশাপাশি বিশেষ যত্নের কারণেও এই গ্রামের আনারস বিশেষ খ্যাতি পেয়েছে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর নরসিংদীর উপ-পরিচালক শোভন কুমার ধর বাংলানিউজকে বলেন, আনারসের চাষ বৃদ্ধিতে কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে চাষিদের প্রযুক্তিগত সহযোগিতা ও পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। জেলার মনোহরদী, বেলাব ও পলাশ উপজেলায় আনারসের চাষ হয়। তবে রাবানের আনারস রসময় ও সুস্বাদু হওয়ায় সারাদেশে এর আলাদা খ্যাতি রয়েছে। করোনা ভাইরাসের কারণে চাষিরা যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সেজন্য আমরা কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের মাধ্যমে আনারস সরবরাহ করার ব্যবস্থা করেছি। যাতে কম খরচে চাষিরা পণ্য পরিবহন করতে পারে।

0Shares

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *