রাজনৈতিক নেতারা রয়েছেন কোভিড সংক্রমণের উচ্চ ঝুঁকিতে

নিউজ ডেস্ক :  দেশব্যাপী ভয়াবহ আকারে ছড়িয়ে পড়ছে করেনাভাইরাস। প্রতিদিনই আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা। প্রায় সব শ্রেণি-পেশার মানুষ আক্রান্ত হলেও রাজনৈতিক নেতা ও সরকারের শীর্ষ ব্যক্তিরা করোনার উচ্চ ঝুঁকিতে আছেন বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। ইতিমধ্যে দেশের শীর্ষ রাজনৈতিক দলগুলোর বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীদের করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ও মৃতু্যর খবর পাওয়া গেছে।যায়যায়দিন (হাসান মোলস্না ও ফয়সাল খান)

নেতারা বলেন, যেকোনো রাজনৈতিক কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে গেলে তারা শারীরিক দূরত্ব রক্ষা করতে পারেন না। তাদের কেউ লাশ দাফন, কেউবা ত্রাণ বিতরণ, আবার কেউ দলীয় দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে আক্রান্ত হয়েছেন। আক্রান্ত নেতাদের বেশির ভাগই বাসায় থেকে চিকিৎসা নিচ্ছেন। অনেকে হাসপাতালেও ভর্তি আছেন।

দেশে করোনাভাইরাস শুরু হওয়ার পর থেকে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কর্মসূচি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, বেশিরভাগ কর্মসূচিতেই শারীরিক দূরত্ব মানা হয়নি। স্বাস্থ্যবিধিরও বালাই ছিল না। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনগুলোর কেন্দ্রীয় বা নগর নেতারা কোনো প্রোগ্রামে গেলেই তাদের ঘিরে ধরে কর্মীরা। সেলফি বা টিভি ক্যামেরায় নেতার সঙ্গে নিজের উপস্থিতি জানান দিতে ধাক্কাধাক্কি করে সামনে যাওয়ার চেষ্টা করেন সবাই। এসব ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যবিধির কোনো বালাই দেখা যায়নি।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের ঢাকা মহানগরীর একাধিক নেতা জানান, মূলত শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে বিশেষ মুহূর্তের ছবি তুলে রাখার জন্যই কর্মসূচিগুলোতে দূরত্ব বজায় রাখা সম্ভব হয় না। মহানগরসহ ইউনিটগুলোতে পূর্ণাঙ্গ কমিটি হয়নি। এসব কমিটির পদপ্রত্যাশীরা কর্মসূচিগুলোতে নিজেদের অবস্থান জানান দিয়ে নেতাদের আস্থা অর্জন করতে চান। পাশাপাশি নেতার সঙ্গে থাকা মুহূর্তের ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট করে কর্মীদেরও চাঙ্গা রাখতে চান।

সংশ্লিষ্টরা বলেন, এসব কার্যক্রমে করোনা ঝুঁকির মধ্যে পড়ছেন দলের বর্ষীয়ান নেতারা। তাছাড়া করোনার মধ্যেও রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় কাজ পরিচালনা করছেন অনেক নেতা। তাদের অনেকেই পরিবারের নিরাপত্তার জন্য নিজেকে আলাদা করে রেখেছেন দীর্ঘদিন।

এরই মধ্যে করোনা আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ১৪ দলের মুখপাত্র ও সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম, ধর্ম প্রতিমন্ত্রী শেখ মোহাম্মদ আবদুলস্নাহ, সিলেট সিটি করপোরেশনের (সিসিক) সাবেক মেয়র ও আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নির্বাহী সংসদের সদস্য বদরউদ্দিন আহমদ কামরান এবং পাবনা-৩ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য বিএনপি নেতা সাইফুল আলম সুজা।

করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃতু্যবরণ করেছেন চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের ৩০ নম্বর পূর্ব মাদারবাড়ি ওয়ার্ড কাউন্সিলর মাজহারুল ইসলাম চৌধুরী এবং করোনার কারণে স্থগিত হয়ে যাওয়া চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সমর্থিত কাউন্সিলরপ্রার্থী মো. হোসেন মুরাদ। এছাড়া শ্রীমঙ্গল পৌরসভার ২ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর আবদুল আহাদ, কবিরহাট পৌরসভার ১ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর আনোয়ার হোসেন ও কালিয়াকৈর পৌরসভার ৭, ৮, ৯ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর হাজেরা বেগম করোনা আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। এছাড়া ঢাকার দুই ওয়ার্ডের যুবলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতিও করোনায় মারা গেছেন।

আরও দুজন মন্ত্রী, ৭ জন এমপি, দেশের বিভিন্ন সিটি করপোরেশ ও পৌরসভার বেশ কয়েকজন মেয়র-কাউন্সিলর ও রাজনৈতিক নেতা করোনায় আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসাধীন আছেন।

করোনা আক্রান্ত হয়ে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ. ক. ম. মোজাম্মেল হক ও তার স্ত্রী এবং পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রী বীর বাহাদুর উশৈসিং ঢাকার সিএমএইচ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন। যশোর-৪ আসনের সাংসদ রণজিৎ কুমার রায়, চট্টগ্রাম-৮ আসনের মোসলেম উদ্দিন, চট্টগ্রাম-১৬ আসনের মোস্তাফিজুর রহমান, জামালপুর-২ আসনের ফরিদুল হক খান দুলাল ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৫ আসনের এবাদুল করিম বুলবুল করোনা আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসাধীন আছেন।

তাছাড়া আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক শফিউল আলম নাদেল, চট্টগ্রাম-৬ আসনের সংসদ সদস্য এ বি এম ফজলে করিম চৌধুরী ও নওগাঁ-২ আসনের শহীদুজ্জামান সরকারও করোনা আক্রান্ত হয়েছিলেন। তারা এখন সুস্থ হয়েছেন বলে জানা গেছে।

সিলেট সিটি করপোরেশনের বর্তমান মেয়র বিএনপি নেতা আরিফুল হক ও তার স্ত্রী শ্যামা হক চৌধুরী এবং একই সিটি করপোরেশনের ২০ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ও মহানগর আওয়ামী লীগ নেতা আজাদুর রহমান আজাদ করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন।

কুমিলস্না সদর উপজেলার চেয়ারম্যান আমিনুল ইসলাম টুটুল ও কুমিলস্না সিটি করপোরেশনের ২১ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর কাজী মাহাবুব, যুবলীগের সাবেক প্রেসিডিয়াম সদস্য ও নরসিংদীর শিবপুর এলাকার সাবেক সংসদ সদস্য সিরাজুল ইসলাম, নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের (এনসিসি) ৪, ৫ ও ৬নং ওয়ার্ডের সংরক্ষিত কাউন্সিলর মনোয়ারা বেগম করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন।

নারায়ণগঞ্জ জেলা বিএনপির নেতা নারায়ণগঞ্জের সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর মাকসুদুল আলম খন্দকার খোরশেদ শুরু থেকে করোনায় মারা যাওয়া ব্যক্তিদের লাশ দাফন করে ব্যাপক আলোচনায় আসেন। সমমনা ব্যক্তিদের সঙ্গে নিয়ে তিনি করোনায় মারা যাওয়া ৪৯ জনের লাশ দাফন করেন। এরপর তিনি ও তার স্ত্রী আফরোজা খন্দকার করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন।

গফরগাঁও পৌরসভার মেয়র এস এম ইকবাল হোসেন সুমন, পটুয়াখালী পৌরসভার মেয়র মহিউদ্দিন আহমেদ, দাউদকান্দি পৌরসভার মেয়র নাইম ইউসুফ, কক্সবাজার পৌরসভার মেয়র মুজিবুর রহমান, চান্দনাইশ পৌরসভার মেয়র মুহাম্মদ মাহবুবুল আলম, চৌদ্দগ্রাম পৌরসভার মেয়র মো. মিজানুর রহমান, ভেড়ামারা পৌরসভার মেয়র শামীমুল ইসলাম সামা ও মীরকাদিম পৌরসভার মেয়র শহিদুল ইসলাম শাহীন করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। করোনা আক্রান্ত পৌর মেয়রদের প্রত্যেকেই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের স্থানীয় রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত।

এ প্রসঙ্গে আলাপকালে করোনা আক্রান্ত কুমিলস্নার চৌদ্দগ্রাম পৌরসভার মেয়র ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মিজানুর রহমান  বলেন, জনপ্রতিনিধি ও রাজনৈতিক দলের নেতা হিসেবে চাইলেও আলাদা থাকা যায় না। দলীয় নেতাকর্মীদের মধ্যে কেউ দেখা করতে এলে বা সমস্যার কথা বলতে এলে সরাসরি না করা যায় না। ত্রাণ বিতরণ করার সময় মানুষের ভিড় সামলাতে হয়েছে। আবার বাড়ি বাড়ি ত্রাণ পৌঁছে দেওয়ার ক্ষেত্রেও অনেকটা ঝুঁকি ছিল বলে জানান তিনি।

ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জের পর করোনার অন্যতম হটস্পট শিল্প এলাকা গাজীপুর। এরই মধ্যে জেলার সবকটি উপজেলাকে রেড জোন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। গাজীপুর সিটি করপোরেশনের বেশ কয়েকজন কাউন্সিলর ইতিমধ্যে করোনা আক্রান্ত হয়েছেন। তবে অন্য সহকর্মীরা ভয়ে কাছে আসবেন না ভেবে তা প্রকাশ না করে নিজেরাই আইসোলেশনে চলে গেছেন।

এ প্রসঙ্গে আলাপকালে গাজীপুর সিটি করপোরেশনের মেয়র ও নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘করোনা শনাক্ত হওয়ার পর থেকেই স্বাস্থ্যবিধি মেনে প্রতিদিনই কাজ করছি। সুরক্ষা উপকরণ ও ত্রাণ বিতরণসহ সিটি করপোরেশনের দাপ্তরিক কাজে নিজে উপস্থিত না থাকলে বিশৃঙ্খলা দেখা দিতে পারে। আমি নিজে ঘরে বসে থাকলে অন্যরা কাজ করবে না। তাই ঝুঁকি নিয়েই সব ধরনের কাজ করে যাচ্ছি।’ তবে পরিবারের ঝুঁকি এড়াতে মা ও স্ত্রী-সন্তানকে নিজের থেকে আলাদা রেখেছেন বলে জানান তিনি।

এদিকে ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক হাসান রমজান মাসে ত্রাণ নিয়ে মানুষের কাছে গেছেন। এরপর করোনায় আক্রান্ত হয়ে তিনি হাসপাতাল থেকে হাসপাতালে ছোটাছুটি করে শেষ পর্যন্ত গত ৭ জুন মারা যান। এছাড়া সারাদেশে ৫৬ জন বিএনপি নেতাকর্মী করোনায় মারা গেছেন।

বিএনপি থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, এখন পর্যন্ত করোনায় নেতাকর্মীর সংখ্যা ১২১ জন। এর মধ্যে রাজশাহী বিভাগে ৫ জন নেতাকর্মী আক্রান্ত হয়েছেন, চট্টগ্রাম বিভাগে আক্রান্ত ২৬ ও মারা গেছেন ১২ জন, কুমিলস্না বিভাগে আক্রান্ত ১৯ ও মৃতু্য ১৩ জন, ঢাকা বিভাগে আক্রান্ত ৪১ ও মৃতু্য ২৭ জন, ময়মনসিংহ বিভাগে আক্রান্ত ও মৃতু্য ১, খুলনা বিভাগে আক্রান্ত ৭ জন, সিলেট বিভাগে আক্রান্ত ৮ ও মৃতু্য ২, ফরিদপুর বিভাগে আক্রান্ত ১৪ ও ১ জন মৃতু্যবরণ করেছেন। এরপরও স্বাস্থ্যবিধি মেনে নিজের এবং পরিবারের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়াতে নেতাকর্মীদের আহ্বান জানিয়েছেন বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতারা।

চলমান মহামারিতে রাজনীতিবিদদের ঝুঁকি প্রসঙ্গে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, সবাই স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে। রাজনীতিবিদরাও এর বাইরে নন। তারা মানুষের কাছে যাচ্ছেন। বিশেষ করে বিএনপি নেতাকর্মীরা মানুষের পাশে আছেন। কেন্দ্রীয়ভাবে করোনা পর্যবেক্ষণ সেল করা হয়েছে। সবাই মাঠে থেকে কাজ করছেন এবং সংক্রমিত হচ্ছেন।

কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) ঢাকা মহানগর কমিটির সাধারণ সম্পাদক ডা. সাজেদুল হক রুবেল বলেন, তার মা এবং মেয়ে করোনায় আক্রান্ত। এছাড়া সারাদেশে দলটির ৩৬ জন নেতাকর্মী করোনা আক্রান্ত হয়েছেন। তাছাড়া সদ্য আত্মপ্রকাশ করা আমার বাংলাদেশ পার্টির (এবি পার্টি) সদস্য সচিব মজিবুর রহমান মনজু করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন বলে জানা গেছে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলেন, নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করেই রাজনীতিবিদদের মাঠে থাকতে হবে। এ মুহূর্তে তারা যেমন একেবারে ঘরে বসে থাকতে পারবেন না, তেমনি নিজেদের নিরাপত্তার কথাও তাদের ভাবতে হবে। যেহেতু করোনা একটি মারাত্মক সংক্রমণ ব্যাধি তাই এর থেকে সাবধানে থাকতে সব রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের জনসমাগম এড়িয়ে কীভাবে কর্মসূচি পালন করা যায় তার পদ্ধতি বের করতে হবে।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক সৈয়দ আনোয়ার হোসেন বলেন, করোনার মতো দুর্যোগে রাজনীতিবিদদের ঘরে বসে থাকার কোনো সুযোগ নেই। তাদের অবশ্যই মানুষের পাশে দাঁড়াতে হবে। তবে সেক্ষেত্রে নিজের ও পরিবারের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে বলে জানান তিনি।

0Shares

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *