চীনভিত্তিক টেনসেন্ট নিয়ন্ত্রিত টেক্সট ও ভয়েস মেসেজিং সেবা উইচ্যাটকে নিষিদ্ধ করতে নির্বাহী আদেশে সই করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প, যা ঠেকাতে চায় অ্যাপল ও ডিজনিসহ একগুচ্ছ মার্কিন প্রতিষ্ঠান। এরই মধ্যে প্রতিষ্ঠানগুলোর পক্ষ থেকে ট্রাম্প প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তাদের কল করা এবং উইচ্যাট ও টিকটককে যুক্তরাষ্ট্রে নিষিদ্ধে নির্বাহী আদেশ বাতিলের আহ্বান জানানো হয়েছে। একই সঙ্গে উইচ্যাট ও টিকটক নিষিদ্ধ করলে চীনে কার্যক্রম রয়েছে এমন মার্কিন প্রতিষ্ঠানগুলো বড় ধরনের ব্যবসায় ক্ষতির মুখে পড়বে বলে সতর্ক করা হয়েছে। খবর ইটি টেলিকম।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, মার্কিন প্রতিষ্ঠানগুলো উইচ্যাট ও টিকটক নিষিদ্ধে ডোনাল্ড ট্রাম্প স্বাক্ষরিত নির্বাহী আদেশের বিষয়ে স্পষ্টতা চেয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে উইচ্যাট নিষিদ্ধ করা হলে কোন ধরনের লেনদেন স্থগিত হবে তা স্পষ্ট করতে বলা হয়েছে।
সম্প্রতি জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি উল্লেখ করে টিকটক ও উইচ্যাট নিষিদ্ধে নির্বাহী আদেশে সই করেছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। ফলে চীনভিত্তিক জনপ্রিয় শর্ট ভিডিও তৈরির সোস্যাল মিডিয়া অ্যাপ টিকটক ও মেসেজিং অ্যাপ উইচ্যাট অ্যাপলের অ্যাপ স্টোর থেকে সরাতে হতে পারে, যা স্মার্টফোনের বৃহৎ বাজার চীনে আইফোন সরবরাহ অন্তত ২৫-৩০ শতাংশ কমাবে বলে সতর্ক করেছেন বিখ্যাত অ্যাপল পণ্য বিশ্লেষক মিং-চি কুয়ো। এমন আশঙ্কা প্রকাশের পর নড়েচড়ে বসেছে অ্যাপল। যে কারণে যুক্তরাষ্ট্রে চীনা দুই অ্যাপের ওপর নিষেধাজ্ঞা ঠেকাতে চাইছে প্রতিষ্ঠানটি।
মিং-চি কুয়োর দাবি, যুক্তরাষ্ট্রে জনপ্রিয় দুই চীনা অ্যাপ নিষিদ্ধে শুধু আইফোন সরবরাহ ও বিক্রিতেই নয়; চীনের বাজারে অ্যাপলের অন্যান্য হার্ডওয়্যার বিক্রি এ যাবত্কালের মধ্যে সর্বোচ্চ কমবে। এ তালিকায় রয়েছে, এয়ারপডস, আইপ্যাড, অ্যাপল ওয়াচ ও ম্যাক কম্পিউটার। এছাড়া ব্যবসার দিক থেকে ক্ষতির মুখে পড়বে ডিজনি, ওয়ালমার্ট ও ফোর্ডের মতো অসংখ্য মার্কিন প্রতিষ্ঠান।
বিশ্লেষকদের ভাষ্যে, উইচ্যাট চীনাদের নিত্যপ্রয়োজনীয় সেবায় পরিণত হয়েছে। উইচ্যাট এখন শুধু একটি মেসেজিং সেবাই নয়; অ্যাপটিতে যুক্ত হয়েছে পেমেন্ট, ই-কমার্স, সোস্যাল নেটওয়ার্কিং ও সংবাদ পড়ার মতো নানা সেবা। বহুব্যবহূত এ অ্যাপ যুক্তরাষ্ট্রে নিষিদ্ধ হলে অসংখ্য চীনা পরিবার ঝুঁকিতে পড়বে। যে কারণে মার্কিন প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান অ্যাপলসহ অন্যদের চীনা ব্যবসায় নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসন যদি শুধু যুক্তরাষ্ট্রে অ্যাপ স্টোর থেকে টিকটক ও উইচ্যাট সরাতে অ্যাপলকে বাধ্য করে, তাহলে বৈশ্বিক বাজারে আইফোন সরবরাহ কমবে ৩-৬ শতাংশ। তবে বৈশ্বিক অ্যাপ স্টোর থেকে দুই অ্যাপ সরাতে বাধ্য করা হলে আইফোন সরবরাহ কমবে ২৫-৩০ শতাংশ, যা অ্যাপলের ডিভাইস ব্যবসা বিভাগের জন্য খুব একটা ভালো হবে না। টানা কয়েক বছর ধরেই ডিভাইস ব্যবসা নিয়ে খারাপ সময় পার করছে অ্যাপল। ওয়াশিংটন-বেইজিংয়ের মধ্যে চলমান বাণিজ্য বিরোধের জেরে টানা কয়েক বছর ধরে চীনে খারাপ সময় পার করছে প্রতিষ্ঠানটি। এতে বাড়তি মাত্রা যোগ করবে যুক্তরাষ্ট্রে টিকটক ও উইচ্যাট নিষিদ্ধে স্বাক্ষরিত নির্বাহী আদেশ।
চীন ১৪৪ কোটি জনসংখ্যার দেশ। বৃহৎ জনগোষ্ঠীর কারণে দেশটি যে কোনো ডিভাইস নির্মাতার জন্যই গুরুত্বপূর্ণ বাজার। চীনভিত্তিক ডিভাইস নির্মাতারা স্থানীয় বাজারে ডিভাইস বিক্রির মাধ্যমেই অ্যাপল ও স্যামসাংকে তীব্র প্রতিযোগিতার মুখে ফেলেছে। চীনভিত্তিক ব্র্যান্ড হুয়াওয়ে, শাওমি, অপো ও ভিভো এখন স্থানীয় বাজারের পাশাপাশি বৈশ্বিক বাজারেও ভালো করছে। এক্ষেত্রে চীনের বাজার হারানো অ্যাপলের জন্য বড় ধরনের ব্যবসায় ক্ষতির কারণ হবে। গত জুনে সমাপ্ত প্রান্তিকে অ্যাপলের মোট রাজস্বের প্রায় ১৫ শতাংশ এসেছে চীনের বাজার থেকে।
শুধু নিষিদ্ধ করাই নয়; উইচ্যাট ও টিকটকের যুক্তরাষ্ট্রের কার্যক্রম মার্কিন কোনো প্রতিষ্ঠানের কাছে বিক্রির পরামর্শ দিয়েছে ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসন। এ সুযোগে টিকটক বাগিয়ে নেয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে মাইক্রোসফট ও টুইটার। চীনভিত্তিক প্রযুক্তি কোম্পানি বাইটডান্স নিয়ন্ত্রিত সোস্যাল মিডিয়া অ্যাপ টিকটক। বেইজিংয়ের অভিযোগ, উইচ্যাট ও টিকটক অ্যাপের যুক্তরাষ্ট্রের কার্যক্রম নানা অজুহাত ও অপকৌশলে বাগিয়ে নেয়ার চেষ্টা করছে ট্রাম্প প্রশাসন, যা কোনো পরিস্থিতিতেই মেনে নেয়া হবে না বলে হুঁশিয়ার করা হয়েছে।
চীনের অভিযোগ, বৈশ্বিক প্রযুক্তি শিল্পে প্রতিযোগিতা নয়; একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তারে ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসন ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতি অনুসরণ করছে। যুক্তরাষ্ট্রে চীনা প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়মিত হেনস্তার শিকার হচ্ছে। চীনা প্রতিষ্ঠানগুলোর অগ্রগতি থামাতে একের পর এক অন্যায় অভিযোগ করা হচ্ছে। মার্কিন প্রতিষ্ঠানগুলোকে টেক্কা দিতে সক্ষম সব চীনা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ওয়াশিংটন তথ্য নিরাপত্তার অভিযোগ তুলছে, যা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। চীনা প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলোকে ব্যবসার দিক থেকে দাবিয়ে রাখতে পরিকল্পিত ধ্বংসলীলা চালাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র।
বেইজিং এরই মধ্যে সতর্ক করেছে যুক্তরাষ্ট্রের এমন অপকৌশলের জবাব দেয়ার যথেষ্ট সুযোগ ও পন্থা চীনের হাতে রয়েছে। চীন প্রশাসন তাদের পরিকল্পিত ধ্বংসযজ্ঞ চালানো শুরু করলে তা মার্কিন প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য খুব একটা ইতিবাচক হবে না। এমন বক্তব্যের মধ্য দিয়ে চীন অনেকটাই স্পষ্ট করেছে যে তাদের প্রতিষ্ঠানগুলোকে ব্যবসার দিক থেকে দাবিয়ে রাখার চেষ্টা করা হলে উৎপাদনের জন্য ৯০ শতাংশ চীনের ওপর নির্ভরশীল অ্যাপলের ওপর খড়গ চালানো হতে পারে। কার্যত ওয়াশিংটন-বেইজিংয়ের বাণিজ্য বিরোধের ভুক্তভোগী হবে অ্যাপল। সামগ্রিক দিক বিবেচনা করেই যুক্তরাষ্ট্রে উইচ্যাট ও টিকটকের ওপর নিষেধাজ্ঞা ঠেকাতে চাইছে অ্যাপল।