যুক্তরাষ্ট্রের ফেলে দেয়া সুযোগ কাজে লাগানোর পথে চীন

যুক্তরাষ্ট্র যেখান থেকে সরে গেছে, চীন সেখানে নিজেদের অবস্থান জোরদার করার পথে রয়েছে। বলা যায়, ওয়াশিংটনের হাতে ঠেলে দেয়া সুযোগই কাজে লাগাচ্ছে বেইজিং। নিজেদের মধ্যে বাণিজ্যের গতি আরো বাড়াতে একটি চুক্তিতে আবদ্ধ হতে যাচ্ছে চীনসহ এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ১৫টি দেশ। এটি হবে বিশ্বের সবচেয়ে বড় মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ), যা অঞ্চলটিতে চীনের প্রভাব আরো জোরদার করবে।

এই ১৫টি দেশে প্রায় ২২০ কোটি মানুষের বসবাস। অর্থাৎ বাজারটি বেশ বড়। আর বৈশ্বিক জিডিপিতে অঞ্চলটির সম্মিলিত অবদান প্রায় এক-তৃতীয়াংশ। সব মিলিয়ে এ ১৫টি দেশের মোট দেশজ উৎপাদনের পরিমাণ প্রায় ২৬ লাখ ২০ হাজার কোটি ডলার। অঞ্চলটিতে একটি বৃহত্তর অর্থনৈতিক ঐক্য গড়ে তুলতে অনেক দিন ধরেই চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল বেইজিং। রিজিওনাল কম্প্রিহেনসিভ ইকোনমিক পার্টনারশিপ (আরসিইপি) নামের এই চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে বেইজিংয়ের সেই তত্পরতা চূড়ান্ত ফল পেতে যাচ্ছে।

চুক্তিবদ্ধ হতে যাওয়া ১৫টি দেশ হলো আসিয়ানভুক্ত ১০টি দেশ—ব্রুনেই, কম্বোডিয়া, ইন্দোনেশিয়া, লাওস, মালয়েশিয়া, মিয়ানমার, ফিলিপাইন, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনাম এবং তাদের এফটিএ অংশীদার পাঁচটি দেশ—অস্ট্রেলিয়া, জাপান, নিউজিল্যান্ড, দক্ষিণ কোরিয়া ও চীন।

২০১২ সালে কম্বোডিয়ায় অনুষ্ঠিত আসিয়ান সম্মেলনে আরসিইপির বিষয়ে আনুষ্ঠানিক আলোচনা শুরু হয়। আসিয়ানের এফটিএ অংশীদার হিসেবে ভারতও প্রথমে এ আলোচনায় যুক্ত ছিল। তবে ২০১৯ সালে তারা নিজেদের প্রত্যাহার করে নেয়। আরসিইপির মূল লক্ষ্য হলো নিজেদের মধ্যে বাণিজ্যে শুল্ক কমানো, সরবরাহ শৃঙ্খল শক্তিশালী করা ও ই-কমার্সের জন্য নতুন বিধিবিধান চালু করা।

আরসিইপির ফলে মার্কিন ও এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের বাইরের বহুজাতিক কোম্পানিগুলো সেখানে ব্যবসা করতে গিয়ে কিছু প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হতে পারে। বিশেষ করে বিদায়ী মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসনের ট্রান্স-প্যাসিফিক পার্টনারশিপ (টিপিপি) আলোচনা থেকে সরে যাওয়া ও আরসিইপি চুক্তি কার্যকরের কারণে মার্কিন কোম্পানিগুলোর এ অঞ্চলে প্রভাব বিস্তার করাটা কঠিন হয়ে পড়বে।

ভিয়েতনামের আয়োজনে চলমান আসিয়ান সম্মেলন শেষে আজই আরসিইপি চুক্তির বিষয়ে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা আসতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। মালয়েশিয়ার বাণিজ্যমন্ত্রী আজমিন আলি সাংবাদিকদের জানান, রোববারই এ চুক্তি স্বাক্ষর হবে।

যুক্তরাষ্ট্রের ছেড়ে দেয়া টিপিপি ও স্বাক্ষর হতে যাওয়া আরসিইপির মধ্যে কিছু কৌশলগত পার্থক্য রয়েছে। ওভারসি-চায়নিজ ব্যাংকিং করপোরেশনের অর্থনীতিবিদ ওয়েলিয়ান উইরানটো বলেছেন, ‘টিপিপির লক্ষ্য ছিল অর্থনীতিতে কিছু মৌলিক পরিবর্তন আনা। অন্যদিকে আরসিইপি হলো অনেকটা বাণিজ্যের দুয়ার উন্মুক্ত করে দেয়ার মতো। আরসিইপিকে অনেকে চীনকেন্দ্রিক চুক্তি বলছেন। তবে আমার মতে, টিপিপি যেভাবে যুক্তরাষ্ট্রকেন্দ্রিক ছিল, এটি সেভাবে বেইজিংয়ের ওপর নির্ভরশীল থাকবে না।’

এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের চুক্তি হলেও এর প্রভাব অঞ্চলটির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে না। একদিকে টিপিপি থেকে যুক্তরাষ্ট্রের পিছু হটা, অন্যদিকে আরসিইপি আলোচনায় গতিশীলতা—এর মাধ্যমে স্পষ্ট হয় যে অর্থনৈতিকভাবে প্রতিবেশী দেশগুলোর ওপর ছড়ি ঘোরানোর যে প্রচেষ্টা বেইজিংয়ের রয়েছে, তা প্রতিহত করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে ওয়াশিংটন। ট্রাম্প প্রশাসনের সেই পদক্ষেপের রেশ নবনির্বাচিত মার্কিন প্রসিডেন্ট জো বাইডেনকেও টানতে হবে।

আরসিইপি এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের অর্থনৈতিক গতিপ্রকৃতি চীনের অনুকূলে নিয়ে নিয়ে আসবে কিনা, তা অনেকখানি নির্ভর করছে যুক্তরাষ্ট্র কী প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে, তার ওপর। সাসবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন প্রশাসনের বাণিজ্যবিষয়ক কর্মকর্তা ও ওয়াশিংটনের সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের জ্যেষ্ঠ পরামর্শক উইলিয়াম রিন্সক এমনটাই মনে করছেন। তিনি বলেন, ‘যদি যুক্তরাষ্ট্র বিষয়টিকে অবজ্ঞা করে এড়িয়ে যায়, তবে প্রভাব বিস্তারের পেন্ডুলাম চীনের দিকে হেলে পড়বে। আর বাইডেন যদি এ অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের সংশ্লিষ্টতা ও প্রভাব ফিরিয়ে আনার জন্য কার্যকর কোনো পরিকল্পনা গ্রহণ করেন, তবে পেন্ডুলামটি ফের যুক্তরাষ্ট্রের দিকে হেলে পড়তে পারে।’ ব্লুমবার্গ।

0Shares

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *