‘মুসলিমদের অনুভূতি বুঝেছি কিন্তু সহিংসতা কখনই মেনে নেয়া হবে না’

মহানবীর ব্যঙ্গচিত্র নিয়ে মুসলিমদের অনুভূতি বুঝতে পারছেন বলে জানিয়েছেন ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রন। কাতারভিত্তিক গণমাধ্যম আল-জাজিরাকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি এই মন্তব্য করেন। দীর্ঘ ওই সাক্ষাৎকারে ম্যাক্রন বলেন, আমি বুঝতে পারছি কেন এই ব্যঙ্গচিত্র দেখে আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে কিন্তু এর জন্য কখনই কোনো সহিংসতা মেনে নেয়া যায় না। এ খবর দিয়েছে ফরাসি গণমাধ্যম ফ্রান্স ২৪।
ম্যাক্রন বলেন, ফ্রান্সের বাকস্বাধীনতা এবং মানুষের অধিকার রক্ষাকেই তিনি তার দায়িত্ব মনে করেন। তিনি তার অবস্থার পক্ষে যুক্তি প্রদান করেন ওই সাক্ষাৎকারে। তিনি বলেন, ব্যঙ্গচিত্র প্রদর্শন তো কোনো সরকারি উদ্যোগ ছিল না। ফ্রান্সের একটি স্বাধীন ও স্বতন্ত্র সংবাদপত্র এটি প্রকাশ করেছে। ফ্রান্সে গণমাধ্যম সরকারের অনুগত নয়।
এই ব্যঙ্গচিত্র দেখে মুসলিমরা কেমন বোধ করবে তা আমি জানি। তাদের অনুভূতিকে আমি শ্রদ্ধা করি। কিন্তু এমন পরিস্থিতিতে আমার ভূমিকা কি হতে পারতো তা আপনাকে বুঝতে হবে। তিনি এরপর বলেন, আমাদেরকে অবশ্যই মানুষের মত প্রকাশের অধিকারকে রক্ষা করতে হবে। একইসঙ্গে শান্তি প্রচার করতে হবে। আমি সবসময় ফ্রান্সে কথা বলার, লেখার, চিন্তাভাবনা করার ও ছবি আঁকার স্বাধীনতা রক্ষা করবো।
ব্যক্তিগতভাবে ম্যাক্রন মহানবীর ব্যঙ্গচিত্র আঁকা সমর্থন করেন না। ওই সাক্ষাৎকারেও তিনি এ কথা জানান। তিনি বলেন, আমার সরকার কখনই ব্যঙ্গচিত্র আঁকা সমর্থন করে না। তবে বাকস্বাধীনতার পক্ষে অবস্থান নেয়ায় অনেকেই ভাবছেন আমরা বিষয়টিকে সমর্থন করছি। তিনি উল্টো উগ্র ইসলামপন্থিদেরকেই মুসলিমদের জন্য হুমকি হিসেবে আখ্যায়িত করেন। ম্যাক্রন বলেন, মুসলিমরা মূলত ক্ষতিগ্রস্ত হয় যারা ইসলামকে বিকৃত করে তাদের কর্মকা-েই। আজ বিশ্বে এমন কিছু লোক আছে যারা ইসলামকে বিকৃত করে। তারা ইসলামের নামে হত্যা ও জবাইকে সমর্থন করে। চরমপন্থি ব্যক্তি ও সংগঠন ইসলামের নামে সহিংসতা তৈরি করছে। অবশ্যই এটি ইসলামের জন্য সমস্যা। কারণ, এসব সন্ত্রাসীর হামলার শিকার মুসলিমরাই। তবে এটি পুরো পৃথিবীর জন্যই একটি সমস্যা।
২০১৫ সালে শার্লি এবদো অফিসে চালানো হামলার মামলা চালু করার সময় সম্প্রতি তাতে নতুন করে ওই ব্যঙ্গচিত্র প্রকাশিত হয়েছে। সেপ্টেম্বরে ওই ব্যঙ্গচিত্র প্রকাশিত হয়। এ সময় তিনি মুক্ত মত প্রকাশের অধীনে ‘রাইট টু ব্লাসফেম’-এর পক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন। এ ঘটনায় তিনি মুসলিম অধিকারকর্মীদের কাছ থেকে ব্যাপক সমালোচনার শিকার হয়েছিলেন। ওই সময় ২রা অক্টোবর তিনি এক বক্তব্যে দাবি করেছিলেন ‘বিশ্বব্যাপী সংকটে ইসলাম’। একই সঙ্গে তিনি ‘ইসলামের সংস্কার’ পরিকল্পনা ঘোষণা করেছিলেন, যাতে তা তার প্রজাতন্ত্রের মূল্যবোধের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হয়।
এরপর ফরাসি শিক্ষক স্যামুয়েল প্যাটির শিরñেদ করার পর ম্যাক্রন তার অবস্থান পুনর্ব্যক্ত করেন। ওদিকে শিক্ষক স্যামুয়েলকে হত্যার নিন্দা জানিয়েছেন ফরাসি মুসলিমরা। একই সঙ্গে তারা এখন আতঙ্কে। তারা মনে করছেন, ইসলামিক সংগঠনগুলোর বিরুদ্ধে এখন শাস্তিমূলক দমনপীড়ন চালাবে সরকার। মসজিদগুলোতে নজরদারি বৃদ্ধি পাবে। তবে ব্যঙ্গচিত্র নিয়ে ম্যাক্রনের বক্তব্যে পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ, বাংলাদেশ থেকে ফিলিস্তিনÑ সর্বত্র মুসলিমরা যোগ দিয়েছেন ফ্রান্সবিরোধী বিক্ষোভে। কিছুদিন ধরে ইসলাম এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ে বিতর্ক গভীর হয়েছে। মুসলিম প্রধান দেশগুলোর সরকারি অনেক কর্মকর্তা এবং বিক্ষোভকারী ফরাসি পণ্য বর্জনের ডাক দিয়েছেন।
ইসলামে মহানবী (সা.)-এর ছবি আঁকা একেবারেই নিষিদ্ধ। ফলে যে ব্যঙ্গচিত্র প্রকাশ করা হয়েছে তাতে তারা ক্ষুব্ধ হয়েছেন। বেড়েছে ইসলামভীতি। কারণ, ওই ব্যঙ্গচিত্রের কারণে ইসলামকে সন্ত্রাসের সঙ্গে জুড়ে দেয়া হয়েছে। এ বিষয়ে ইমানুয়েল ম্যাক্রন বলেছেন, বিশ্বে বর্তমানে এমন অনেক মানুষ আছেন, যারা ইসলামকে বিকৃত করছেন। তারা হত্যা, গলা কেটে হত্যার পক্ষে অবস্থান নিতে ধর্মকে ব্যবহার করেন। বর্তমানে ইসলামের নামে কিছু চরমপন্থি আন্দোলনকারী এবং ব্যক্তিবিশেষ সহিংসতা চর্চা করেন। ম্যাক্রন বলেন, অবশ্যই এটা ইসলামের জন্য একটি সমস্যা। কারণ, এতে প্রথম ভিকটিম হচ্ছেন মুসলিমরা। সন্ত্রাসের শিকারে পরিণত হচ্ছেন এমন শতকরা ৮০ ভাগের বেশি মানুষ মুসলিম। এটা আমাদের সবার জন্যই একটি সমস্যা।

আল জাজিরার সিনিয়র রাজনৈতিক বিশ্লেষক মারওয়ান বিশারা বলেছেন, ম্যাক্রন তার বক্তব্যের মধ্য দিয়ে তার অবস্থান পরিষ্কার করার চেষ্টা করেছেন। যেসব ইস্যু ফ্রান্স ও মুসলিম দুনিয়ার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণÑ সেসব বিষয়ে তিনি কথা বলেছেন। তিনি আরো বলেন, আমি মনে করি ক্ষতি যা হওয়ার তা হয়ে গেছে। আমার মনে হয় না যে, এই উত্তেজনা অব্যাহত রাখা উচিত। কারণ, দিনশেষে দেখা যাবে কেউই বিজয়ী নন। মারওয়ান বিশারা আরো বলেন, বহু মুসলিম দেশের সঙ্গে সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় ইস্যুতে কাঁধে কাঁধ রেখে অবস্থান করছে ইউরোপ। ফলে উত্তেজনার মধ্যে কেউই বিজয়ী নন। যদি এতে কারো লোকসান বা ক্ষতি হয়ে থাকে তাহলে তারা হবেন ইউরোপে বসবাসকারী বিপুল সংখ্যক মুসলিম। তাই ফরাসি প্রেসিডেন্ট এখন যেহেতু আন্তরিকভাবে বুঝতে পেরেছেন কেন ওই ব্যঙ্গচিত্র বিতর্কিত এবং তিনি একটি ধর্ম হিসেবে ইসলামের সমালোচনা করেননিÑ তখন ফ্রান্স, ইউরোপ এবং মুসলিম বিশ্বের মধ্যে আবহ উন্নতকরণ শুরু করা উচিত।

0Shares

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *