মানহীন লুব্রিক্যান্টের কারণে চ্যালেঞ্জে বড় কোম্পানিগুলো

গাড়ি কিংবা কল-কারখানার ইঞ্জিনের অভ্যন্তরীণ যন্ত্রাংশকে নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় ঠাণ্ডা রাখতে লুব্রিক্যান্ট ব্যবহার করা হয়। দেশে দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে এই লুব্রিক্যান্ট ব্যবসা চলছে। দেশের অন্তত ডজনখানেক কোম্পানি বিদেশী ব্র্যান্ডের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়ে এ খাতে বিনিয়োগ করেছে। ফলে এ খাতে দেশেই গড়ে উঠেছে বেশকিছু বড় কোম্পানি। ব্যবসায়ীরা বলছেন, আন্তর্জাতিকমানের লুব্রিক্যান্ট ব্লেন্ডিং হচ্ছে দেশে, যা বিদেশেও রফতানি করা হচ্ছে। তবে বেশকিছু নামমাত্র কোম্পানি তেলের স্পেসিফিকেশন মান না মেনে বিদেশী ব্র্যান্ডের নামে লুব্রিক্যান্ট রিফিল করছে। এতে একদিকে যেমন গাড়ি কিংবা কল-কারখানার ইঞ্জিন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। অন্যদিকে লুব্রিক্যান্ট ব্যবসার মান ধরে রাখার ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছে বড় কোম্পানিগুলো।

লুব্রিক্যান্ট বা লুব অয়েল মূলত বিদেশ থেকে আমদানি করা কাঁচামাল দেশে ব্লেন্ডিং করা হয়। দেশে ট্রান্সপোর্ট ব্যবসা প্রসারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এ খাতের ব্যবসাও প্রসারিত হয়েছে। তবে আমদানি করা এসব অয়েলের মান এবং পরিশোধনের প্রক্রিয়া যথাযথভাবে তদারকি না হওয়ায় বাজারে নিম্নমানের লুব্রিক্যান্টের সরবরাহ বাড়ছে।

সুনির্দিষ্টভাবে কোনো পরিসংখ্যান না থাকলেও ব্যবসায়ীদের দেয়া তথ্যমতে, দেশীয় বাজারে লুব অয়েলের বর্তমান চাহিদা ১ লাখ ৬০ হাজার থেকে ১ লাখ ৭০ হাজার টনের মতো। দেশে ৭০-৮০টি কোম্পানি লুব অয়েল বাজারজাত করছে। আর দেশে ব্লেন্ডিং করছে ১৫টির মতো কোম্পানি। এসব কোম্পানি দেশীয় বাজারে লুব্রিক্যান্টের চাহিদা পূরণের পাশাপাশি নিজস্ব নামে লুব রফতানি করছে বিদেশে। বর্তমানে লুব ব্যবসায় বাজার প্রসারিত হয়েছে ৫ হাজার কোটি টাকার। বাণিজ্যিক নগরী চট্টগ্রামে বেশির ভাগ কোম্পানি গড়ে উঠেছে। সেখান থেকে ব্লেন্ডিং করে দেশের বাজারে লুব অয়েল সরবরাহ করা হচ্ছে।

নাম প্রকাশ্যে অনিচ্ছুক বেশ কয়েকজন ব্যবসায়ী জানিয়েছেন, দেশের বাজারে লুব অয়েল ব্যবসা প্রসারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিনিয়োগ করেছে অনেক কোম্পানি। এসব কোম্পানি তেলের স্ট্যান্ডার্ড স্পেসিফিকেশন মান না মেনেই লুব বাজারজাত করছে। অন্যদিকে লুব অয়েল ব্যবহারের পর সেগুলো সংগ্রহ করার কোনো পলিসি না থাকায় দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছোট ছোট কারখানায় তা পরিশোধন করে বোতলজাত করে বাজারে ছাড়া হচ্ছে। এসব কারণে একদিকে যেমন বড় কোম্পানিগুলোর লুবের মান ধরে রাখার ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ তৈরি হয়েছে, অন্যদিকে আসল লুব ক্রয়ের ক্ষেত্রে ভোক্তাদের কাছে জটিলতা তৈরি হয়েছে।

দেশীয় বাজারে লুব্রিক্যান্ট ব্যবসার বর্তমান অবস্থা জানতে চাইলে এমজেএল বাংলাদেশ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আজম জে চৌধুরী বণিক বার্তাকে বলেন, দেশে বর্তমানে আন্তর্জাতিকমানের লুব্রিক্যান্ট তৈরি হচ্ছে। বড় ব্র্যান্ডগুলো এখন নিজেই ভালো মানের লুব আমদানি করে দেশে ব্লেন্ডিং করে বাজারজাত করছে। ফলে এ ব্যবসার ভবিষ্যৎ অনেক ভালো। তবে পলিসিগত কিছু সমস্যাও রয়েছে।

নিম্নমানের অয়েল আমদানি করে লুব বাজারজাতের বিষয়ে তিনি বলেন, সরকারকে আমরা এ বিষয় নিয়ে অনেক আগেই বলেছি। কেউ লুব্রিক্যান্ট আমদানি করতে চাইলে তার স্ট্যান্ডার্ড নির্ধারণ করতে হবে। সে আসলে কোথায় এ অয়েল ব্যবহার করতে চায়, সেটি আগে দেখতে হবে। প্রতিটি ইন্ডাস্ট্রির লুব্রিক্যান্ট স্ট্যান্ডার্ড মান একেক ধরনের। সেসব কোম্পানির আমদানি করা লুব টেস্ট করার পর একটা স্পেসিফিকেশন হবে। কিন্তু আমাদের দেশে লুব আমদানিকারকদের ক্ষেত্রে এসব আইনগত দিক-মান মানার প্রবণতা খুবই কম।

লুব্রিক্যান্ট শিল্পকে স্বনির্ভর করে বিদেশে রফতানি করতে দেশে প্লান্ট স্থাপনের পরিকল্পনা করছে ‘বিএনও’ ব্র্যান্ড বাজারজাতকারী লুব-রেফ। দেশীয় এই ব্র্যান্ড কয়েক বছর ধরে নেপালে তাদের পণ্য রফতানি করছে। তবে বড় পরিসরে রফতানি না করলেও বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটি ৪০০ কোটি টাকা বিনিয়োগে বেজ রিফাইনারি প্লান্ট স্থাপনের পরিকল্পনা করছে। ২০২৫ সালের মধ্যে লুব ব্যবসার ২০ শতাংশ নিজেদের দখলে রাখতে চায় কোম্পানিটি।

লুব্রিক্যান্ট তৈরির কারখানা স্থাপন, ট্যারিফ হার, আমদানি নীতিমালা, তেলের স্পেসিফিকেশন মান দেখভালের জন্য সমন্বিতভাবে নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে কাজ করছে জ্বালানি বিভাগ, বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি), বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) এবং বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন (বিএসটিআই)। মূলত লুব অয়েল আমদানি করার ক্ষেত্রে তেলের মান নির্ধারণে দুই ধরনের পরীক্ষা প্রয়োজন হয়। একটি হলো টেকনিক্যাল রিসোর্স এবং অন্যটি হলো হিউম্যান রিসোর্স। এর কোনোটির যথাযথ দেখভাল করার সক্ষমতা নেই সরকারি এ সংস্থাগুলোর। ফলে এ সুযোগ নিয়ে নিম্নমানের লুব আমদানির সুযোগ নিচ্ছে কেউ কেউ।

বিষয়টি নিয়ে কথা বললে জ্বালানি বিভাগের সিনিয়র সচিব আনিসুর রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, নিম্নমানের লুব্রিক্যান্ট অয়েল যদি কেউ আমদানি করে থাকে তাহলে বিষয়টি আমরা খতিয়ে দেখব। তাছাড়া বিপিসি ও বিইআরসি এটা নিয়ে কাজ করছে। এ ধরনের একটি সম্ভাবনাময় ব্যবসায় যারা কালোবাজারি করার সুযোগ নিচ্ছে, অবশ্যই সেটা মনিটরিং করে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

দেশীয় বাজারে লুব্রিক্যান্ট কোম্পানিগুলো স্ট্যান্ডার্ড স্পেসিফিকেশন মেনে চলছে কিনা এমন বিষয় জানতে চাইলে বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক মোমিনুর রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, দেশীয় বাজারে লুব অয়েলের যে মান থাকা দরকার, সেটি অনেক কোম্পানি মেনে চলছে না। বাজারে একই গ্রেডের বিভিন্ন কোম্পানির লুব অয়েলের কোয়ালিটি একেক রকম। স্ট্যান্ডার্ড স্পেসিফিকেশনের ক্ষেত্রে ২/১ মানা হচ্ছে, বাকিগুলো মানা হচ্ছে না। যে কারণে বাজারে নিম্নমানের অয়েল সরবরাহ বাড়ছে।

তিনি আরো বলেন, এসব জালিয়াতি ধরার জন্য নিয়মিত বাজার মনিটরিং প্রয়োজন। তাছাড়া এ ধরনের জ্বালানি আমদানি এবং ব্যবহারের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলোর যে পলিসি রয়েছে, সেখানে বেশ কিছু ঘাটতি রয়েছে। এগুলোর সমন্বয় হওয়া প্রয়োজন। পলিসিগত কারণে লুব অয়েল আমদানিকারকরা সেটি অনেক ক্ষেত্রে মানতে পারছে না।

0Shares

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *