মদ-বিয়ার আমদানি হচ্ছে পানির দরে

মদ বিয়ার
ফাইল ছবি

পরিমাণ কিংবা সর্বনিম্ন আমদানি মূল্য বেঁধে না দেওয়ায় ডিপ্লোমেটিক বন্ডেড ওয়্যারহাউজগুলো পানির দরে অ্যালকোহলযুক্ত মদ ও বিয়ার আমদানি করছে। এর ফলে বাস্তবে কূটনৈতিক ও বিশেষ সুবিধাভোগী বিদেশি নাগরিকদের বছরে যে পরিমাণ মদ ও বিয়ারের চাহিদা রয়েছে তার চেয়ে বেশি পরিমাণ ঢুকছে দেশে। চাহিদার অতিরিক্ত মদ ও বিয়ার চলে যাচ্ছে খোলাবাজারে। এমনকি বাসাবাড়িতেও। বন্ডেড ওয়্যারহাউজগুলোর এসব কারসাজি জানার পর শুল্ক গোয়েন্দা ও চট্টগ্রাম কাস্টমস জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) চিঠি দেয়। সেখানে কারসাজি নিয়ন্ত্রণের জন্য শুল্কমুক্ত সুবিধায় ন্যূনতম মূল্য অথবা পরিমাণ বেঁধে দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়। তবে সাত মাস পার হলেও অদ্যাবধি প্রস্তাবটির বিষয়ে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।

অ্যালকোহলমুক্ত এক লিটার বিয়ারের ন্যূনতম আমদানি মূল্য আড়াই ডলার নির্ধারণ করা আছে। অথচ ডিপ্লোমেটিক বন্ডেড ওয়্যারহাউজগুলো অ্যালকোহলযুক্ত বিয়ার (৩৩০ মি.লি.র ক্যান) এক ডলারেরও কম দামে আমদানি করছে। শুধু তাই নয়, হুইস্কিজাতীয় মদ আমদানি করছে দেড় থেকে ২ ডলারে।

তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, সম্প্রতি একটি ডিপ্লোমেটিক বন্ড ৩৫ হাজার ৫০০ লিটার বিয়ার, ১৩ হাজার লিটার হুইস্কি এবং প্রায় ১৪ হাজার লিটার ওয়াইনজাতীয় মদ আমদানি করে। বিয়ারের আমদানি মূল্য ঘোষণা দেওয়া হয় ৬৩ সেন্ট (এক ডলারের কম)। হুইস্কি ও ওয়াইনের মূল্য যথাক্রমে এক ডলার ৯১ সেন্ট ও এক ডলার ১২ সেন্ট। অথচ চলতি অর্থবছরের বাজেটে ন্যূনতম মূল্যের প্রজ্ঞাপনে অ্যালকোহলমুক্ত মদের ন্যূনতম আমদানি মূল্য আড়াই ডলার নির্ধারণ করে দেওয়া আছে।

এ বিষয়ে চট্টগ্রাম কাস্টমসের কমিশনার ফখরুল আলম বলেন, ‘ওই চালানটি আটক করা হয়েছিল। পরে আদালতের অন্তর্বর্তী আদেশের পরিপ্রেক্ষিতে সাময়িক শুল্কায়ন করা হয়েছে। এ ধরনের চালানের ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বিকল্প চিন্তা-ভাবনা আছে।’

প্রসঙ্গত, আমদানি পণ্যের মূল্য বেঁধে দেওয়াকেই ন্যূনতম মূল্য বলা হয়। আমদানিকারক এই মূল্যের চেয়ে কম দামে পণ্য বিদেশ থেকে কিনলেও বাংলাদেশে বেঁধে দেওয়া মূল্যে পণ্যের অ্যাসেসমেন্ট করা হয়ে থাকে।

কাস্টমসের তথ্য মতে, গত এক বছরে শুল্কমুক্ত সুবিধায় ১৪৭টি আমদানি চালানের মাধ্যমে ২২ লাখ ৪ হাজার ৯০৫ লিটার মদ-বিয়ার আমদানি হয়েছে। বিশেষ সুবিধাভোগী ব্যক্তি ও কূটনৈতিকদের কাছে বিক্রির শর্তেই কেবল ডিপ্লোমেটিক বন্ডগুলো শুল্কমুক্ত সুবিধায় এসব পণ্য আমদানি করতে পারে। সূত্রের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে অবস্থানরত কূটনীতিকদের সংখ্যা প্রায় দেড় হাজার। এ হিসাব ধরলে একজন ব্যক্তি বছরে প্রায় ১৫০০ লিটার মদ-বিয়ার পান করার কথা। অথচ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য মতে, ২০১৯ সালে মাথাপিছু সবচেয়ে বেশি বিশুদ্ধ অ্যালকোহল পানকারী দেশ হচ্ছে চেক রিপাবলিক ১৪ লিটারের কিছু বেশি। এরপরের অবস্থানে আছে যথাক্রমে লাটভিয়া ১৩ লিটার, মালদোভা ও জার্মানি ১২ লিটারের বেশি। আমেরিকার নাগরিকরা পান করে ১০ লিটারের কাছাকাছি। এতে প্রতীয়মান হয় যে, শুল্কমুক্ত সুবিধায় আনা মদ-বিয়ারের অপব্যবহার হচ্ছে।

সূত্রমতে, শুল্কমুক্ত সুবিধায় আনা মদ-বিয়ার খোলাবাজারে বিক্রি বন্ধে এনবিআর একটি সফটওয়্যার চালু করে। এ সফটওয়্যারে প্রতিটি ডিপ্লোমেটিক বন্ডকে মদ-বিয়ার আমদানির যাবতীয় তথ্য যেমন- বিল অব এন্ট্রি নম্বর, আমদানি করা পণ্যের ব্র্যান্ড ও নাম, পরিমাণ, সিআইএফ মূল্য এন্ট্রি করার নির্দেশ দেওয়া হয়। একই সঙ্গে পণ্য বিক্রির সময় কূটনৈতিক বা বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত ব্যক্তির পাশবুক অথবা কর অব্যাহতির সনদ নম্বর এবং পাসপোর্টের তথ্য যাচাই করে বরাদ্দ অনুযায়ী পণ্য বিক্রি এবং এক্স বন্ড নম্বর, বিক্রীত পণ্যের নাম, পরিমাণ সফটওয়্যারে এন্ট্রি দেওয়ার নির্দেশ দেয়। কিন্তু সাইবার নিরাপত্তার অজুহাতে সফটওয়্যার ব্যবহারে অনীহা প্রকাশ করে ডিপ্লোমেটিক বন্ডগুলো আদালতে রিট করে। রিট মামলাটি এখনো নিষ্পত্তি হয়নি।

বিশ্লেষকরা বলছেন, মদ চুরির পথ খোলা রাখছে খোদ এনবিআরই। তবে সফটওয়্যার ছাড়াও অন্য পন্থায় মদ চুরির পথ বন্ধ করা সম্ভব। যেমন-বর্তমানে ডিপ্লোমেটিক বন্ডগুলোকে ডলারে আমদানি প্রাপ্যতা দেওয়া হয়। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে প্রতিষ্ঠানগুলো আন্ডার ইনভেসিংয়ের মাধ্যমে মদ-বিয়ার খালাস করছে। ধরা যাক, এক বোতল বিয়ারের আন্তর্জাতিক বাজারমূল্য এক ডলার। কিন্তু দেশের ডিপ্লোমেটিক বন্ডগুলো এক বোতল বিয়ার আমদানি করছে ৫০ সেন্টে। এভাবে এক ডলারে ২ বোতল বিয়ার খালাস নেওয়া হচ্ছে। এ কায়দায় এনবিআরের বেঁধে দেওয়া মূল্যের ভেতরে থেকেই বেশি পরিমাণ মদ এনে তা খোলাবাজারে বিক্রি করা সম্ভব। অ্যালকোহলমুক্ত বিয়ারের মতো অ্যালকোহলযুক্ত মদ-বিয়ারের ন্যূনতম আমদানি মূল্য আরোপের মাধ্যমে খুব সহজেই চুরি ঠেকানো সম্ভব। অথবা ডলারের পরিবর্তে ডিপ্লোমেটিক বন্ডগুলোকে লিটারে আমদানি প্রাপ্যতা দেওয়া হলেও অপব্যবহার অনেকাংশে কমে আসবে।

এ বিষয়ে এনবিআরের সাবেক সদস্য ফরিদ উদ্দিন যুগান্তরকে বলেন, ‘ডিপ্লোমেটিক বন্ডের অপব্যবহার বন্ধে এনবিআরসহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলো কিছুই করেনি। প্রতিষ্ঠার শুরুতে যেখানে ছিল, এখনো সেখানেই আছে। বাংলাদেশে অবস্থানরত বিশেষ সুবিধাভোগী ব্যক্তি ও কূটনীতিকদের আপডেট তালিকা এনবিআর ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে আছে কিনা সন্দেহ আছে। মূলত এ সুযোগই নিচ্ছে বন্ডগুলো। যে কূটনৈতিক কর্তব্য পালন শেষে নিজ দেশে ফেরত গেছেন তাদের পাশবুকে মদ-বিয়ার বিক্রি হয়। এই মদ-বিয়ার বিভিন্ন ক্লাব ও উচ্চবিত্তদের বাসাবাড়িতেও দেখা যায়। তিনি আরও বলেন, শুল্কমুক্ত সুবিধায় আনা মদ-বিয়ার বিক্রি করতে চাইলে পুরো প্রক্রিয়াটিকে ডিজিটালাইজ করতে হবে। তার আগে বাংলাদেশে অবস্থানরত কূটনৈতিক তালিকা হালনাগাদ করতে হবে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, এনবিআর, চট্টগ্রাম কাস্টমস ও বন্ড কমিশনারেট এক্ষেত্রে সমন্বিতভাবে কাজ করতে পারে।’

কোনো উদ্যোগই আলোর মুখ দেখছে না : গত ১৬ মে চট্টগ্রাম কাস্টমস মদ-বিয়ার আমদানিতে ডিপ্লোমেটিক বন্ডগুলোর আন্ডার ইনভয়েসিংয়ের বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরে এনবিআরে চিঠি দেয়। এ অপতৎপরতা বন্ধে মদ-বিয়ার আমদানিতে ন্যূনতম মূল্য আরোপ অথবা ডলারের পরিবর্তে আমদানি প্রাপ্যতা লিটারে দেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়। কিন্তু সেই চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে কোনো কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়নি। একইভাবে ১৮ নভেম্বর ডিপ্লোমেটিক বন্ডগুলোকে শৃঙ্খলায় আনতে ও ন্যূনতম মূল্য নির্ধারণে ভ্যাট গোয়েন্দা, শুল্ক মূল্যায়ন, চট্টগ্রাম কাস্টমস, ঢাকা কাস্টমস, ঢাকা বন্ড কমিশনারেট, ঢাকা সব ভ্যাট কমিশনারেটের সমন্বয়ে সভা আহ্বানের প্রস্তাব দেওয়া হয়। একই সঙ্গে ডিপ্লোমেটিক বন্ডের অর্থ পাচারের তদন্ত করতে শুল্ক গোয়েন্দা, শুল্ক মূল্যায়ন, বন্ড কমিশনারেট ও কাস্টমস হাউজের কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে তদন্ত কমিটি গঠনের প্রস্তাব দেওয়া হয়। কিন্তু সেটিও আলোর মুখ দেখেনি।

চট্টগ্রাম কাস্টমসের কমিশনার ফখরুল আলম যুগান্তরকে বলেন, শুল্কমুক্ত সুবিধায় মদ-বিয়ার আমদানিতে আন্ডার ইনভয়েসিং হয়। এটি বন্ধে এনবিআরকে দুটি প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। এখন এনবিআর পরবর্তী ব্যবস্থা নেবে।

কাস্টমস কর্মকর্তারা বলছেন, ডিপ্লোমেটিক বন্ডগুলো ভিয়েনা কনভেনশনের দোহাই দিয়ে একের পর এক অপকর্ম করে যাচ্ছে। আইন-কানুনের কোনো তোয়াক্কাই করছে না। সম্প্রতি শুল্ক মূল্যায়ন ও নিরীক্ষা কমিশনারেট একটি প্রতিষ্ঠানের অডিটের কাজে হাত দেয়। এজন্য ওই প্রতিষ্ঠানের কাছে মদ-বিয়ার আমদানির তথ্য চাওয়া হলে প্রতিষ্ঠানটি তথ্য দেয়নি। শুল্ক গোয়ন্দাও অপর একটি প্রতিষ্ঠানের অর্থ পাচারের অনুসন্ধান করছে। এজন্য তথ্য চাওয়া হলে দেয়নি ওই প্রতিষ্ঠান। এছাড়া ভ্যাট গোয়েন্দা স্থানীয় একটি বারের ভ্যাট ফাঁকির অনুসন্ধানের জন্য প্রতিষ্ঠানটির কাছে ভ্যাট রিটার্ন ও বার্ষিক অডিট রিপোর্ট চেয়েছিল। প্রতিষ্ঠানটি সহযোগিতা না করায় পরে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক থেকে প্রতিষ্ঠানটির অডিট রিপোর্ট ও ভ্যাট সার্কেল থেকে রিটার্ন সংগ্রহ করা হয়। শুধু কাস্টমস-আয়কর বিভাগ নয়, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরকেও পাত্তা দেয় না। যেমন-মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন অনুযায়ী, বন্ডেড ওয়্যারহাউজগুলো মদ আমদানির জন্য অনুমতি নিতে বাধ্য। কিন্তু তারা নিয়ম না মেনে মদ আমদানি করছে। ফলে প্রতিষ্ঠানগুলো বছরে কী পরিমাণ মদ-বিয়ার আমদানি করছে তার তথ্য অধিদপ্তরের কাছে নেই।

প্রসঙ্গত, ভিয়েনা কনভেনশন হচ্ছে-স্বাধীন দেশগুলোর কূটনৈতিক সম্পর্ক বিষয়ক আন্তর্জাতিক চুক্তি। এ চুক্তির স্বাক্ষরকারী দেশগুলোতে অন্য দেশের কূটনীতিকরা বিশেষ সুবিধা ভোগ করে থাকে। যেমন কূটনীতিকরা শুল্কমুক্ত সুবিধায় নিত্যব্যবহার্য পণ্য এবং ব্যক্তিগত গাড়ি আমদানি করতে পারেন। বিশেষ ক্ষেত্র ছাড়া অপরাধমূলক কার্যক্রমের জন্য কূটনৈতিক ব্যক্তিরা বিচারের আওতাবহির্ভূত।

0Shares

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *