বৃটেন থেকে বাংলাদেশে বিক্রি হওয়া জাহাজগুলোয় কাজ করতে গিয়ে আহত হলে জাহাজ বিক্রিকারী বৃটিশ প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলা করতে পারবেন ক্ষতিগ্রস্থ বাংলাদেশি শ্রমিকরা। দেশটির একটি আদালত এমন রায় দিয়েছে। এ খবর দিয়েছে দ্য গার্ডিয়ান।
খবরে বলা হয়, ইংল্যান্ড ও ওয়েলস-এর আপিল আদালত সম্প্রতি ঐতিহাসিক এক রায়ে বলেছে, দক্ষিণ এশিয়ায় জাহাজ বিক্রিকারী লন্ডনের কোম্পানিগুলোর বাংলাদেশের জাহাজ ভাঙা শ্রমিকদের প্রতি ‘ডিউটি অব কেয়ার’ বা তত্ত্বাবধানের আইনি দায়বদ্ধতা থাকে। বিক্রিতে একাধিক তৃতীয় পক্ষ জড়িত থাকলেও এ দায়বদ্ধতা বিদ্যমান থাকে বলে জানান আদালত। পুরো বিশ্বজুড়ে কোনো সর্বোচ্চ পর্যায়ের আদালত থেকে আসা এমন রায় এটিই প্রথম।
বৃটিশ জাহাজ কোম্পানিগুলো তাদের পুরনো জাহাজগুলো ভাঙার জন্য দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোর কাছে বিক্রি করে থাকে। এর মধ্যে বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও ভারতে কম খরচে ও ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশে এসব জাহাজ ভাঙা হয়।
এধরণের কাজে প্রায়ই শ্রমিকরা আহত হন।
আপিল আদালতের এই রায়ের ফলে এখন থেকে ওই শ্রমিক বা তাদের পরিবাররা বৃটিশ কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে মামলা করতে পারবেন। এরকম একজন হচ্ছেন, চট্টগ্রামে ২০১৮ সালে লন্ডন-ভিত্তিক জাহাজ কোম্পানি মারানের একটি তেলের ট্যাংকারে কাজ করা অবস্থায় ৮ তলা সমান উচ্চতা থেকে পড়ে গিয়ে মারা যাওয়া শ্রমিক খালিদ মোল্লাহর স্ত্রী হামিদা বেগম। রায়টির ফলে মারানের বিরুদ্ধে মামলা করতে পারবেন তিনি।
তবে বাংলাদেশের ঢিলেঢালা পরিবেশ, স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তাজনিত চর্চার দিকে গুরুত্বআরোপ করা হলে রায়টি ঘিরে আরও মামলা চালু হতে পারে। যার ফলে, কাজের পরিবেশ উন্নত করতে বাধ্য হতে পারে এশীয় জাহাজ ভাঙার ইয়ার্ডগুলো।
দীর্ঘ দিন ধরে চলা অন্য দুটি মামলার রায়ের উপর ভিত্তি করে সিদ্ধান্ত জানিয়েছে ইংল্যান্ড ও ওয়েলসের আপিল আদালত। ওই মামলা দুটিতেও নিম্ন আয়ের দেশগুলোকে পরিবেশ দূষণ ও ক্ষতির অভিযোগে বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে মামলা করার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল।
গত ১৫ বছরে চট্টগ্রামের জাহাজ ভাঙার ইয়ার্ডগুলোতে আনুমানিক ২১৬ জন শ্রমিক মারা গেছেন। এর মধ্যে কেবল চলতি বছরেই এখন অবধি ৭ জন প্রাণ হারিয়েছেন। আরও অনেকে গুরুতরভাবে আহত হয়েছেন, শারীরিকভাবে অক্ষম হয়ে গেছেন।
চট্টগ্রামের জাহাজ ভাঙার ইয়ার্ডগুলো নোংরা, বিপজ্জনক ও নিরাপত্তাহীন হিসেবে বিশ্বজুড়ে পরিচিত। কিন্তু জাহাজ কোম্পানিগুলো কিছু কৌশল অবলম্বন সেখানে জাহাজ বিক্রির দায়বদ্ধতা এড়িয়ে যেতে পেরেছে। এর মধ্যে রয়েছে বিক্রির ঠিক আগ দিয়ে জাহাজটির মালিকানা পরিবর্তন, ট্যাক্স হেভেন ও মধ্যস্ততাকারী ব্যবহার।
প্রতি বছরই ইয়ার্ডগুলোতে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা না থাকায়, উঁচু স্থান থেকে পড়ে গিয়ে, বিস্ফোরণে ও দুর্ঘটনায় আহত ও নিহত হন অনেক শ্রমিক। পাশাপাশি, স্থানীয় উপকূলীয় পরিবেশ ব্যাপকভাবে দূষিত করে তুলেছে মেয়াদ উর্ত্তীর্ণ হয়ে যাওয়া জাহাজের তেল, বিপজ্জনক রাসায়নিক পদার্থ ও অ্যাসবেস্টস।
লন্ডন-ভিত্তিক আইনি সংস্থা লেই ডে জানান, বৃটিশ জাহাজ শিল্প ইচ্ছাকৃতভাবে বাংলাদেশের দুর্বল নীতিমালার সুযোগ নেয়। যার ফলে বিত্তবান জাহাজ মালিকরা প্রায় নিশ্চিত থাকেন যে, বেশি নিরাপদ ও স্বাস্থ্যকর ইয়ার্ডগুলোয় জাহাজ ভাঙতে গেলে যে অর্থ খরচ হবে তার চেয়ে অনেক কম খরচে বাংলাদেশের অস্বাস্থ্যকর ও নিরাপত্তাহীন অবস্থায় অল্প খরচে জাহাজগুলো ভাঙ্গা যাবে।
এনজিও শিপব্রেকিং প্ল্যাটফর্ম অনুযায়ী, প্রতি বছর অকেজো হয়ে পড়ে প্রায় ৮০০ জাহাজ। এর মধ্যে ৭০ শতাংশই বাংলাদেশে, পাকিস্তানে বা ভারতে বিক্রি করা হয় ভাঙার জন্য।