‘বাংলাদেশকে শান্তি প্রতিষ্ঠাকারী দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করুন’

‘শান্তি প্রতিষ্ঠা’কে একটি মহৎ কাজ অভিহিত করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীদের  জাতীয় পতাকার মান সমুন্নত রেখে বিশ্বে বাংলাদেশকে একটি শক্তিশালী শান্তি প্রতিষ্ঠাকারী দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, আপনারা বাংলাদেশকে বিশ্বে একটি শক্তিশালী শান্তি প্রতিষ্ঠাকারী দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করবেন এবং এর পতাকার মর্যাদা সমুন্নত রাখবেন। বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে কর্মরত শান্তিরক্ষীদের উদ্দেশ্যে প্রধানমন্ত্রী বলেন, পেশাদারিত্ব ও সততা বজায় রেখে নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সঙ্গে স্ব স্ব দায়িত্ব পালন করতে হবে। নিজেদের সুরক্ষিত রেখে আত্মবিশ্বাস নিয়ে দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করতে কাজ করবেন। কারণ বিশ্ব শান্তি প্রচার করা একটি মহৎ কাজ। গতকাল বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে ‘আন্তর্জাতিক জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী দিবস-২০২২’ উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণে এসব কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী। গণভবন থেকে ভার্চ্যুয়ালি অনুষ্ঠানে যোগ দেন প্রধানমন্ত্রী।

প্রধানমন্ত্রী অনুষ্ঠান থেকে ভার্চ্যুয়ালি সংযুক্ত দক্ষিণ সুদান, লেবানন, সেন্ট্রাল আফ্রিকা রিপাবলিক এবং কঙ্গোতে অবস্থানকারী বাংলাদেশি কন্টিনজেন্টের সঙ্গে মতবিনিময় করেন। তিনি ইউএন পিস কিপিং জার্নালের একটি ভলিউমের মোড়কও উন্মোচন করেন। আইন বিচার ও সংসদ বিষয়কমন্ত্রী আনিসুল হক, সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল এসএম শফিউদ্দিন আহমেদ, জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনের সামরিক উপদেষ্টা জেনারেল বিরামে ডিওপ এবং বাংলাদেশে জাতিসংঘের আবাসিক প্রতিনিধি জিওন লুইস অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করেন। আইন বিচার ও সংসদ বিষয়কমন্ত্রী আনিসুল হক প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে শান্তিরক্ষা মিশনে দুই শহীদের পরিবারকে এবং সাহসিকতার জন্য একজনকেসহ ১৪ জন আহত শান্তিরক্ষীকে পদক প্রদান করেন। বিজ্ঞাপন

অনুষ্ঠানের শুরুতে বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠার মহৎ উদ্দেশ্যে জীবন উৎসর্গকারী শান্তিরক্ষীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়।

অনুষ্ঠানে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশের ৩৪ বছরের যাত্রার ওপর একটি ছোট ভিডিও ডকুমেন্টারিও প্রদর্শিত হয়। শেখ হাসিনা এই বছরের শান্তিরক্ষী দিবসের থিম ‘জনগণের শান্তি অগ্রগতি: অংশীদারিত্বের শক্তি’-এর মাধ্যমে বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় আরও কার্যকর ভূমিকা পালন করার অঙ্গীকার করেন। তিনি বলেন, আমি বিশ্বাস করি, আমাদের সশস্ত্র বাহিনী এবং পুলিশ বাহিনীর তরুণ সদস্যরা ২১ শতকের বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সক্ষম। সব সময় মনে রাখবেন যেকোনো দায়িত্ব পালনে আত্মবিশ্বাসটা হচ্ছে সব থেকে বড় কথা। কাজেই সকলে আত্মবিশ্বাস নিয়ে স্ব স্ব দায়িত্ব পালন করবেন। তাহলেই আপনারা সফল হবেন।

 প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমি জাতিসংঘের আহ্বানে সাড়া দিয়ে প্রয়োজনে আরও শান্তিরক্ষী পাঠাতে প্রস্তুত। বিশ্ব করোনা ভাইরাসের মতো মহামারি অতিক্রম করতে করতেই আবার একটি যুদ্ধের দামামা (রাশিয়া-ইউক্রেন) বেজে উঠেছে। যা আজকে বিশ্ব অর্থনীতির ওপর বিরাট প্রভাব ফেলেছে। তিনি বলেন, আমরা কোনো যুদ্ধ বা সংঘাত চাই না, শান্তি চাই। সারা বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হোক- সেটাই আমাদের কাম্য। বিশ্ববাসীর পাশাপাশি বাংলাদেশের জনগণ বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় আপনাদের এই ভূমিকা চিরকাল স্মরণ রাখবে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে বৈরিতা নয়’ নীতি ঘোষণার মাধ্যমে জাতির পিতা বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশের সুদৃঢ় অবস্থান তুলে ধরেন। এই নীতি আমরা এখনো মেনে চলছি এবং সকলের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখেই দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে মনোনিবেশ করেছি। শান্তির স্বপক্ষে দৃঢ় অবস্থান পুনর্ব্যক্ত করে তিনি বলেন, ‘যুদ্ধ নয় আমরা শান্তি চাই, সংঘাত নয়, উন্নতি চাই’।

তখন থেকেই বাংলাদেশ বিশ্বের শান্তিপ্রিয় ও বন্ধুপ্রতিম সকল দেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখে চলেছে এবং বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় জাতিসংঘের অধীনে পরিচালিত সকল শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করছে এবং ভবিষ্যতেও করবে। তিনি বলেন, জাতির পিতার শান্তি সেনানীরূপে ১৯৮৮ সালে বাংলাদেশ বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় প্রথম শান্তিরক্ষী প্রেরণ করে ‘ব্লু হেলমেট’ পরিবারের সদস্য হয়। আজ আমরা ‘সর্বোচ্চ শান্তিরক্ষী প্রেরণকারী দেশ’ হিসেবে গৌরবের ৩৪ বছর উদযাপন করছি। আজ সমগ্র বিশ্বে শান্তিরক্ষায় সক্রিয় অংশগ্রহণকারী হিসেবে বাংলাদেশের অবস্থান সর্বজনবিদিত এবং এই অবস্থান নিশ্চিতভাবে আমাদের সশস্ত্র বাহিনী এবং পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা অক্লান্ত পরিশ্রম ও নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালনের স্বীকৃতি বলেও প্রধানমন্ত্রী উল্লেখ করেন। 

শেখ হাসিনা বলেন, সমসাময়িক বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে বিশ্ব শান্তি নিশ্চিত করা অতীতের চেয়ে অনেক বেশি চ্যালেঞ্জিং হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রযুক্তির দ্রুত প্রসার ও অগ্রযাত্রার সঙ্গে রাষ্ট্রীয় এবং অরাষ্ট্রীয় অপশক্তিসমূহ নতুন হুমকি হিসেবে দেখা দিয়েছে। ফলে বর্তমানে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনগুলোতে শান্তিরক্ষীদের বহুমাত্রিক ও জটিল পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হচ্ছে। জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা অপারেশনে এই নতুন চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলায় আমরা আমাদের শান্তিরক্ষীদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণ ও সরঞ্জামাদি দিয়ে প্রস্তুত করে তুলছি। তিনি বলেন, ১৯৯৯ সালে জাতিসংঘে আমাদের উত্থাপিত ‘শান্তির সংস্কৃতি’ শীর্ষক প্রস্তাব সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়। তখন থেকে প্রতি বছর এটি জাতিসংঘ কর্তৃক স্বীকৃত হয়ে আসছে।

 ১৯৯৯ সালে বাংলাদেশে ‘পিস কিপিং অপারেশন ট্রেনিং সেন্টার’ প্রতিষ্ঠিত হয়। পরবর্তীকালে ২০০২ সালে এটি ‘বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস সাপোর্ট অপারেশন ট্রেনিং-বিপসট’ হিসেবে পূর্ণাঙ্গ ইনস্টিটিউটের মর্যাদা পায়। বিশ্বে এটি বর্তমানে শান্তিরক্ষীদের অন্যতম শ্রেষ্ঠ প্রশিক্ষণ কেন্দ্র হিসেবে পরিগণিত হয়েছে। বাংলাদেশে এই ইনস্টিটিউট স্থাপন বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠায় আমাদের অঙ্গীকারেরই প্রতিফলন বলেও তিনি উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, এ মুহূর্তে বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় ১২১টি দেশের ৭৫ হাজার ৫১৬ জন শান্তিরক্ষী নিয়োজিত রয়েছেন। এর মধ্যে বাংলাদেশের ৬ হাজার ৮২৫ জন শান্তিরক্ষী রয়েছেন।

 বর্তমানে বাংলাদেশের ৫১৯ জন নারী শান্তিরক্ষী বিশ্ব শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে নিয়োজিত আছেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমি জেনে আনন্দিত যে, বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী এবং পুলিশ বাহিনী তাদের মহিলা শান্তিরক্ষীদের অংশগ্রহণ পর্যায়ক্রমে বৃদ্ধি করে চলেছে। তাছাড়া জাতিসংঘ মহাসচিব শান্তিরক্ষা মিশলে আরও বেশিসংখ্যক নারী সদস্যকে সম্পৃক্ত করার আগ্রহ দেখিয়েছেন। আমরা বলেছি, আমরা সব সময় প্রস্তুত। তিনি বলেন, আমাদের শান্তিরক্ষীরা ৪৩টি দেশে ৫৫টি মিশন সফলতার সঙ্গে সম্পন্ন করেছেন। বর্তমানে ১৩টি মিশনে আমাদের শান্তিরক্ষীরা নিয়োজিত রয়েছেন। এ ছাড়াও বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর বেশকিছু উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা বিভিন্ন মিশনে ডেপুটি ফোর্স কমান্ডার এবং সেক্টর কমান্ডার হিসেবে দাযিত্ব পালন করছেন। জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি রাবাব ফাতিমা বর্তমানে জাতিসংঘের পিস-বিল্ডিং কমিশনের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী শান্তি প্রতিষ্ঠায় শহীদ বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীদের আত্মার শান্তি কামনা করেন এবং শোক সন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি সমবেদনা জানান। তিনি শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে শহীদদের রুহের মাগফিরাত কামনা করেন এবং শোক-সন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের সমবেদনা জানান।

পাঠকের মতামত

মন্তব্য সমূহ পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য সম্পাদক দায়ী নন।

0Shares

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *