প্রাণে বাঁচার সম্ভাবনা ছিল মুয়াম্মার গাদ্দাফির

২০১১ সালের কথা। গৃহযুদ্ধের আগুন জ্বলে উঠেছে লিবিয়ায়। সরকারি বাহিনীর সঙ্গে লড়াই চালাচ্ছে ন্যাটোর সমর্থনপুষ্ট গাদ্দাফিবিরোধী বিদ্রোহীরা। বিরতিহীন হামলা চালিয়ে যাচ্ছে ন্যাটোও। রক্তক্ষয়ী এ গৃহযুদ্ধের ভবিষ্যৎ নিয়ে লিবিয়াবাসীর মধ্যে দেখা দিয়েছে আতঙ্ক ও শঙ্কা। তবে ভবিষ্যতের দুর্যোগের আভাস তখনো তাদের কল্পনায়ও আসেনি।

গৃহযুদ্ধ শুরুর মাস দুয়েক পরের কথা। লিবিয়ার রাজধানী ত্রিপোলির দুই হাজার মাইল দূরে অসলোর একটি হোটেলে এক গোপন বৈঠক চলছে। আলোচনায় বসেছে গৃহযুদ্ধে বিবদমান পক্ষগুলো।

ব্রিটিশ একটি গণমাধ্যমে সম্প্রতি ওই আলোচনার বিষয়বস্তু প্রকাশ হয়েছে। লিবিয়ায় ন্যাটোর বোমাবর্ষণ শুরুর দশম বার্ষিকীতে প্রথম ওই আলোচনার বিষয়বস্তু প্রকাশ হয়। ওই প্রতিবেদনের ভাষ্যমতে, আলোচনা সফল হলে শান্তিপূর্ণভাবে শেষ হতো লিবিয়ার গৃহযুদ্ধ। সেক্ষেত্রে দেশটি বর্তমানে যে দুর্যোগপূর্ণ পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, সেটিও এড়ানো যেত ভালোভাবেই।

আলোচনায় উভয় পক্ষ ঐকমত্যে পৌঁছেছিল, মুয়াম্মার গাদ্দাফি লিবিয়ায় তার ৪২ বছরের শাসনের সমাপ্তি ঘটাবেন শান্তিপূর্ণভাবেই। তিনি তার পদ থেকে সরে দাঁড়াবেন। তবে লিবিয়ার শাসন ব্যবস্থার প্রাতিষ্ঠানিক রূপটি একই রকম থাকবে।

তবে এ আলোচনা ভেস্তে যায়। গৃহযুদ্ধের এক পর্যায়ে বিদ্রোহীদের হাতে আটক হন গাদ্দাফি। হত্যা করা হয় তাকে। ন্যাটোর সহায়তায় বিদ্রোহীরা গৃহযুদ্ধে জয় পেলেও মারাত্মক সংকটে পড়ে লিবিয়া। দেশটির পরের এক দশকের ইতিহাস শুধু হানাহানি আর সংঘাতের। এ সময় লিবিয়া হয়ে উঠেছে সন্ত্রাসী সংগঠন ইসলামিক স্টেটের (আইএস) দ্বিতীয় বৃহত্তম ঘাঁটি। এ সংঘাতের ইতি কবে ঘটবে, সে বিষয় এখনো জানা নেই কারো। যদিও গত সপ্তাহেই দেশটিতে নতুন এক অন্তর্বর্তীকালীন জোট সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করেছে। এখন পর্যন্ত লিবিয়াকে সংঘাতের রক্তাক্ত পথ থেকে বের করে আনার এটিই সর্বশেষ রাজনৈতিক প্রয়াস।

২০১১ সালের নরওয়ের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন জোনাস স্টোর। মূলত তার উদ্যোগেই ওই বৈঠকটির আয়োজন করা হয়। জোনাস স্টোর পরবর্তী সময়ে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, আলোচনাটি ভেস্তে গিয়েছিল শুধু ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্যের কারণে। দেশ দুটি কোনোভাবেই চাইছিল না, আলোচনার ভিত্তিতে এ সংঘাতের কোনো ধরনের সমাধান আসুক।

ওই সময়ে যুক্তরাজ্যের সরকারপ্রধান ছিলেন দেশটির তত্কালীন প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন। ফ্রান্সের নেতৃত্ব দিয়েছেন তদানীন্তন প্রেসিডেন্ট নিকোলা সারকোজি। নিন্দুকেরা বলে, যেকোনো উপায়ে লিবিয়ায় ক্ষমতার পালাবদল সফল করতে তারা সে সময় মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন। যদিও এ অভিযোগ বরাবরই তারা দুজনেই অস্বীকার করে এসেছেন।

এ বিষয়ে জোনাস স্টোরের ভাষ্য হলো আমি বুঝতে পারছিলাম, কূটনৈতিক সমাধানের পথ করে দেয়ার বিষয়টি লন্ডন ও প্যারিসের চিন্তাতেও ছিল না। তারা (ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্য) কি আদতে সামরিক সমাধানের বাইরে অন্য কিছু ভেবেছিল? এ প্রশ্নের কোনো উত্তর নেই।

তিনি আরো বলেন, যদি আন্তর্জাতিক মহল এ পথে (আলোচনার মাধ্যমে সমাধান) আরো সক্ষমতা ও সদিচ্ছা নিয়ে এগোত; আমার বিশ্বাস তাহলে ঘটনার সমাপ্তি এতটা নাটকীয় হতো না। একই সঙ্গে লিবিয়ার রাষ্ট্র ব্যবস্থার ধসও ঠেকানো যেত।

অন্যান্য আরব দেশের পথ ধরে ২০১১ সালের দিকে লিবিয়াতেও বিক্ষোভ শুরু হয়। বিক্ষোভকারীদের দাবি ছিল, গাদ্দাফির শাসনের ইতি ঘটাতে হবে। এ বিক্ষোভ দমনে কঠোর পদক্ষেপ নেয় নিরাপত্তা বাহিনী। বিক্ষোভকারীদের দমনের দৃঢ়প্রতিজ্ঞা ঘোষণা করেন গাদ্দাফিও।

২০১১ সালের ১৭ মার্চ জাতিসংঘে লিবিয়ায় হস্তক্ষেপের সপক্ষে ভোটাভুটি হয়। এর পরের সাত মাস লিবিয়ার সামরিক বাহিনীর ওপর সাত হাজারেরও বেশিবার আঘাত হেনেছে ন্যাটোর যুদ্ধবিমান।

অন্যদিকে গাদ্দাফির মিত্ররা চাইছিলেন, পরিস্থিতির সমাধান হোক আলোচনার ভিত্তিতে। গাদ্দাফির ছেলে সাইফ আল-ইসলাম ওই সময় জনসম্মুখে বিদ্রোহ কঠোরভাবে দমনের হুঁশিয়ারি দিয়ে যাচ্ছিলেন। যদিও আলোচনা শুরু ও মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা নিতে নরওয়ের শীর্ষ কর্মকর্তাদের ত্রিপোলিতে ডেকে আনেন তিনি।

নিউইয়র্কে যখন জাতিসংঘের অধিবেশনে লিবিয়ার হস্তক্ষেপ নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল, সে সময় নরওয়ে সরকারের দুই শীর্ষ কর্মকর্তা ত্রিপোলির প্রেসিডেন্ট প্যালেসে অবস্থান করছিলেন। পরে ন্যাটোর বিমান হামলা শুরুর বিষয়টি অবশ্যম্ভাবী হয়ে এলে তাদের সীমান্ত পার করে পৌঁছে দেয়া হয় তিউনিসিয়ায়।

ন্যাটোর বিমান হামলাগুলোয় সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছে নরওয়ে। দেশটির বৈমানিকরা লিবিয়ায় বোমা ফেলেছেন ৬০০টির কাছাকাছি। আবার ঠিক সে সময়ই আলোচনার মাধ্যমে সংকট সমাধানের প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছিলেন দেশটির তত্কালীন প্রধানমন্ত্রী জেন্স স্টোলটেনবার্গ। পররাষ্ট্রমন্ত্রী জোনাস স্টোরকে আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। এসব আলোচনার আয়োজন হয়েছে নরওয়েতেই।

আগে বিভিন্ন সংঘাতে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে ভূমিকা রেখেছে নরওয়ে। বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের সংঘাত নিরসনে বরাবরই কূটনৈতিক প্রয়াস চালিয়ে গিয়েছে অসলো। এসব আলোচনার অনেকগুলোই হয়েছে লোকচক্ষুর অন্তরালে। ১৯৯৩ সালেও ইসরায়েল ও পিএলওর মধ্যকার চুক্তিতেও অবদান রেখেছিল নরওয়ে। দেশটির মধ্যস্থতায় সে সময় ইসরায়েল ও পিএলও একে অপরকে স্বীকৃতিও দিয়েছে।

তবে লিবিয়ার সংঘাত নিরসনে নরওয়ে একা উদ্যোগ নিয়েছে, বিষয়টি এমনও নয়। লিবিয়ায় বিবদমান পক্ষগুলোর মধ্যে শান্তিচুক্তির উদ্যোগ নিয়ে এগিয়ে এসেছিল আফ্রিকান ইউনিয়নও। কিন্তু সাফল্যের কাছাকাছি গিয়েছিল শুধু নরওয়ে।

উভয় পক্ষের সঙ্গে কয়েক দফা দরকষাকষির পর জেন্স স্টোরের উদ্যোগে আলোচনা শুরু হয়। অসলোর একটি হোটেলে প্রথমবারের মতো মুখোমুখি হয় লিবিয়ার সরকার ও বিদ্রোহী পক্ষের জ্যেষ্ঠ কর্তারা। দিনটি ছিল ২০১১ সালের ২৭ এপ্রিল।

গাদ্দাফি অনুগতদের প্রতিনিধি হিসেবে আলোচনায় অংশ নেন মোহাম্মদ ইসমাইল। গাদ্দাফির ছেলে সাইফ আল-ইসলামের ডান হাত হিসেবে পরিচিতি রয়েছে তার। অন্যদিকে বিদ্রোহী পক্ষের প্রতিনিধি ছিলেন আলি জেইদান। বিদ্রোহীদের গড়ে তোলা ন্যাশনাল ট্রানজিশনাল কাউন্সিলের এ জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা গাদ্দাফি-পরবর্তী লিবিয়ায় প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বও পালন করেছেন।

জোনাস স্টোর জানান, ওই আলোচনার পরিবেশ ছিল পুরোপুরি আবেগঘন। দুই পক্ষের প্রতিনিধিদেরই বক্তব্যে নিজ দেশের প্রতি তাদের মমত্ববোধ ফুটে উঠছিল।

নরওয়েজীয় কূটনৈতিকদের চাপাচাপিতে সংকটের ইতি ঘটাতে একটি সমন্বিত পরিকল্পনার খসড়াও করা হয়। এ পরিকল্পনার শুরুটা হয় এভাবে—‘কর্নেল গাদ্দাফি ক্ষমতা ছেড়ে সরে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন’।

এ পরিকল্পনা নিয়ে সাইফ আল-ইসলামের সঙ্গেও কথা বলেছেন জোনাস স্টোর। এক্ষেত্রে তার উদ্দেশ্য ছিল, আলোচনায় গৃহীত সিদ্ধান্তে লিবিয়ার সর্বোচ্চ পর্যায়ের সমর্থন নিশ্চিত করা।

এক্ষেত্রে পরের প্রশ্নটি দাঁড়ায়, ক্ষমতা ছাড়ার পর মুয়াম্মার গাদ্দাফির কী হবে? গাদ্দাফি ক্ষমতা ও রাজনীতি ছাড়তে রাজি হলেও লিবিয়া ছাড়তে রাজি ছিলেন না। এ পর্যায়ে গাদ্দাফি লিবিয়ায় থাকতে পারবেন কি পারবেন না, সে বিষয়ের মধ্যেই ঘুরপাক খেতে থাকে আলোচনা।

জোনাস স্টোরের আত্মজীবনী লিখেছেন নরওয়েজীয় লেখক স্টেল উইগ। ওই আলোচনার বিষয়বস্তু প্রথম জনসম্মুখে তিনি এনেছিলেন। স্টেল উইগ জানান, গাদ্দাফির পরিবার ও ঘনিষ্ঠজনেরাসহ লিবিয়ার আইনি কাঠামোর অংশীজনের সবাই গাদ্দাফির ক্ষমতা ছাড়ার বিষয়টিতে সমর্থন দিয়েছেন। অপেক্ষা ছিল শুধু গাদ্দাফি দেশ ছাড়তে রাজি হওয়ার।

এ বিষয়ে জোনাস স্টোর স্বীকার করে নিয়েছেন, গাদ্দাফি শেষ পর্যন্ত ক্ষমতা ছাড়তেন কিনা বা চরমপন্থী কোনো দল এ সমাধান মেনে নিত কিনা, সে বিষয় নিয়ে ‘আমরা এখনো জানি না’। কিন্তু পশ্চিমা বড় দেশগুলো যে আলোচনার মাধ্যমে সমাধানে আগ্রহী ছিল না, সে বিষয়টি পরিষ্কার।

তিনি জানান, অসলোয় দুই পক্ষের মধ্যকার ঐকমত্যের বিষয়টি যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্যের কাছে উত্থাপন করা হয়েছিল। এর মধ্যে বিষয়টিতে আগ্রহ দেখিয়েছেন শুধু তত্কালীন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন। অন্য দুই দেশের এ নিয়ে কোনো আগ্রহই ছিল না।

অথচ লিবিয়ায় তখন গৃহযুদ্ধ পরিস্থিতি এক ধরনের অচলাবস্থায় ছিল। স্টোরের মতে, ওই সময় যদি এ নিয়ে তারা আগ্রহ দেখাত, তাহলে উভয় পক্ষের মধ্যে যুদ্ধবিরতির আশাও থাকত। সেক্ষেত্রে কূটনৈতিকরা বিষয়টি নিয়ে সরাসরিই সক্রিয় হয়ে উঠতে পারতেন।

তিনি বলেন, কিন্তু এরপর সামরিক অভিযান চলেছে মাত্র আট সপ্তাহ। যুদ্ধক্ষেত্রের পরিস্থিতিতেও দ্রুত পরিবর্তন আসছিল এবং এ ধরনের প্রক্রিয়া নিয়ে এগোনোর মতো সদিচ্ছা আর কারো ছিল না।

ওই সময় ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন উইলিয়াম হেগ। ওই সময়কার ভূমিকা নিয়ে ব্রিটিশ গণমাধ্যমে তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। সাড়া দেয়নি ডেভিড ক্যামেরনের দপ্তরও। তবে তিনি তার আত্মজীবনীতে দাবি করেছেন, লিবিয়ায় যেনতেনভাবে সরকার পরিবর্তন তার উদ্দেশ্য ছিল না।

ডেভিড ক্যামেরনের দাবি, আলোচনার ভিত্তিতে সমাধানের জন্য তিনি একের পর এক প্রয়াস চালিয়েছেন। কিন্তু গাদ্দাফি তাতে আগ্রহী ছিলেন না।

২০১১ সালের যুদ্ধ লিবিয়াকে ঠেলে দেয় আরো বড় ও রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধের দিকে। এ গৃহযুদ্ধ চলেছে গত দশকের অধিকাংশ সময়জুড়েই। দেশটি হয়ে উঠেছে আঞ্চলিক শক্তিগুলোর যুদ্ধক্ষেত্র। বারাক ওবামা পরবর্তী সময়ে স্বীকার করেছেন, মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে তার সবচেয়ে বড় ভুল ছিল সংঘাত-পরবর্তী লিবিয়ার ক্ষমতাকাঠামো নিয়ে কোনো পরিকল্পনা না করা।

জোনাস স্টোর বর্তমানে নরওয়ের বিরোধী দল লেবার পার্টির নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তার মতে, ২০১১ সালের ওই আলোচনাটি পশ্চিমা শক্তিগুলোর কাছে গুরুত্ব না পাওয়ার বিষয়টি ছিল দুঃখজনক। এর পরের এক দশকে লিবিয়ায় যা হয়েছে, তা আরো দুঃখজনক।

0Shares

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *