নিষেধাজ্ঞায় পুতিনের কী আসে-যায়

রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন
রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন

রাশিয়ার ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা জারি কিংবা নিষেধাজ্ঞার হুমকি নতুন কিছু নয়। তবে এবার সত্যিই নতুন কিছু শোনালেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন।

গত মঙ্গলবার বাইডেন সবাইকে চমকে দেন। তিনি খোলামেলাভাবে বলেন, রাশিয়া যদি ইউক্রেনে আগ্রাসন চালায়, তাহলে দেশটির প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের ওপর ব্যক্তিগতভাবে নিষেধাজ্ঞা আরোপের বিষয়টি বিবেচনা করবে যুক্তরাষ্ট্র।

পরদিন বুধবার যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্রমন্ত্রী লিজ ট্রসও বাইডেনের সুরে সুর মেলান। তিনি বলেন, ইউক্রেনে হামলা হলে পুতিনের ওপর ব্যক্তিগত নিষেধাজ্ঞাসহ যেকোনো পদক্ষেপ নিতে পারে তাঁর দেশ।

যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইঙ্গিত দেন যে ইউক্রেনে হামলার জবাবে তাদের সব মিত্র একই কাজ করবে। তারা সম্মিলিতভাবে পদক্ষেপ নেবে। সবাই পুতিনকে দেখিয়ে দেবে যে তারা ঐক্যবদ্ধ।বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন

হুমকির জবাব দিতে সময় নেয়নি রাশিয়া। বুধবার রাশিয়ার পক্ষ থেকে বলা হয়, প্রেসিডেন্ট পুতিনের ওপর ব্যক্তিগতভাবে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হলে তা তাঁকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে না। বরং তা বুমেরাং হবে। এমন নিষেধাজ্ঞার পরিণতি রাজনৈতিকভাবে ধ্বংসাত্মক হবে।

ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ পশ্চিমাদের স্মরণ করিয়ে দেন, রুশ প্রেসিডেন্টের ওপর নিষেধাজ্ঞা হবে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করার শামিল।

পেসকভের ভাষায়, ‘রাষ্ট্রপ্রধানের বিরুদ্ধে, রাশিয়ার প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ, আমি আবার বলছি, এটি হবে একটি বাড়াবাড়ি রকমের পদক্ষেপ, যা সম্পর্ক ছিন্ন করার সঙ্গে তুলনীয়।’

ঠিক একই ধরনের পাল্টা পদক্ষেপ নেওয়ার ব্যাপারে মস্কো প্রস্তুত আছে বলেও জানিয়ে দেন ক্রেমলিনের মুখপাত্র।

কিয়েভ, ওয়াশিংটনসহ পশ্চিমাদের অভিযোগ, ইউক্রেনে হামলা চালানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে রাশিয়া। এ জন্য তারা ইউক্রেন সীমান্তে প্রায় এক লাখ সেনার সমাবেশ ঘটিয়েছে।বিজ্ঞাপন

তবে রাশিয়ার দাবি, ইউক্রেনে হামলা চালানোর মতো কোনো পরিকল্পনা তারা করছে না। বরং মস্কো পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটোকে নিয়ে তার নিরাপত্তা হুমকির কথা জানাচ্ছে। ন্যাটো যাতে ইউক্রেনসহ অন্যদের এই জোটের সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত না করে, সেই দাবি রাশিয়ার।

মস্কোর প্রস্তুতি দেখে পশ্চিমা নেতারা বারবার সতর্ক করে আসছেন যে ইউক্রেনে আগ্রাসন চালানো হলে রাশিয়াকে চড়া মূল্য দিতে হবে। পশ্চিমা নেতাদের এমন হুমকির মধ্যে বাইডেনের ঘোষণাটি নিঃসন্দেহে বিরল ও ব্যতিক্রম।

এ প্রসঙ্গে বিবিসির কূটনৈতিক প্রতিবেদক জেমস ল্যান্ডালের পর্যবেক্ষণ হলো, সরকার বা রাষ্ট্রপ্রধানদের ওপর পশ্চিমা শক্তিগুলোর নিষেধাজ্ঞা আরোপের বিষয়টি অভূতপূর্ব নয়। অতীতে জিম্বাবুয়ের রবার্ট মুগাবে, সিরিয়ার বাশার আল আসাদ, লিবিয়ার মুয়াম্মার গাদ্দাফিসহ অনেক সরকার বা রাষ্ট্রপ্রধানের ওপর পশ্চিমা শক্তিগুলোর ব্যক্তিগত নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে দেখা গেছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, জিম্বাবুয়ে, সিরিয়া, লিবিয়ার মতো দেশের নেতার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ এক বিষয়, আর রাশিয়ার মতো পরাশক্তিধর দেশের প্রেসিডেন্টের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ আরেক বিষয়।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন
মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন

পুতিন শুধু একটি দেশের প্রেসিডেন্ট নন। একই সঙ্গে তিনি একজন শক্তিশালী আঞ্চলিক ও বিশ্বনেতা। পুতিনের দেশ রাশিয়া জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য। জাতিসংঘের কোনো স্থায়ী সদস্য রাষ্ট্রের প্রধানের ওপর অপর একটি স্থায়ী সদস্য রাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা আরোপের বিষয়টি বিরল।

অনেক আঞ্চলিক সমস্যার সমাধানে পুতিনের ভূমিকাকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তাঁর ওপর ব্যক্তিগত নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হলে এসব ইস্যুর সমাধান তো দূরের কথা, তা আরও জটিল আকার ধারণ করবে। উদাহরণ হিসেবে ইরান ইস্যুর কথা বলা যায়। ইরানের সঙ্গে বিশ্বশক্তিগুলোর পারমাণবিক চুক্তি পুনরুজ্জীবিত করতে পশ্চিমাদের অবশ্যই পুতিনের সহায়তা দরকার। একই কথা বলা যায় সিরিয়ার ক্ষেত্রেও। সিরিয়ায় চলমান যুদ্ধের অবসান ঘটাতে পুতিন সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখতে পারেন।

বিশ্বনেতা হিসেবে অনেক আন্তর্জাতিক সংকটের সমাধানেও পুতিনকে দরকার। যেমন জলবায়ু সংকট। পুতিনের ওপর ব্যক্তিগত নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হলে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে একটা বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে। নিরাপত্তা পরিষদে রাশিয়ার ভেটো ক্ষমতা রয়েছে। নিরাপত্তা পরিষদে কোনো প্রস্তাব পাস করাতে হলে রাশিয়ার সমর্থন ছাড়া তা সম্ভব হবে না।

পুতিনের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হলে পশ্চিমা নেতারা আর তাঁর সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে আলোচনা করতে পারবেন না। কোনো আলোচনার জন্য পুতিন নিজে যেমন জেনেভায় যেতে পারবেন না, আবার পশ্চিমা নেতারাও মস্কোতে গিয়ে তাঁর সঙ্গে বৈঠক করতে পারবেন না।

ইউক্রেন সীমান্তে প্রায় এক লাখ সেনার সমাবেশ ঘটিয়েছে রাশিয়া
ইউক্রেন সীমান্তে প্রায় এক লাখ সেনার সমাবেশ ঘটিয়েছে রাশিয়া

যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, ইউক্রেনে হামলা হলে সব মিত্র একই কাজ করবে। কিন্তু ইউরোপীয় ইউনিয়নের সব দেশ পুতিনের ওপর ব্যক্তিগত নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে সম্মত না-ও হতে পারে। কারণ, তাতে তাদের ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা আছে।

পুতিনের ব্যক্তিগত সম্পদের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিলে তা কাজে দেবে না বলে মনে করেন কোনো কোনো বিশেষজ্ঞ। এই ঘরানার বিশেষজ্ঞদের মতে, পুতিনের সম্পদ তৃতীয় পক্ষের হাতে রাখা আছে। ফলে পুতিনের সম্পদের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিলে তাতে তাঁর কিছু যাবে বা আসবে না।

কানাডার কনকর্ডিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের শিক্ষক জুলিয়ান স্পেন্সার-চার্চিল এই ঘরানার বিশেষজ্ঞ। তিনি মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমারা পুতিনের ব্যক্তিগত সম্পদের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিলে তা কাজ দেবে না।

অন্যদিকে, কানাডাভিত্তিক থিঙ্কট্যাংক এমএলআইয়ের সিনিয়র ফেলো মার্কাস কোলগা মনে করেন, ইউক্রেন ইস্যুতে পুতিনকে থামানোর একটি মোক্ষম অস্ত্র হতে পারে ব্যক্তিগত নিষেধাজ্ঞা। পুতিন, তাঁর ঘনিষ্ঠজন, সহযোগী, সমর্থক—সবাইকে এই নিষেধাজ্ঞার আওতায় আনতে হবে।

করোনা মহামারি মোকাবিলায় ব্যর্থতাসহ নানা কারণে নিজ দেশে পুতিনের জনপ্রিয়তা কমেছে। পুতিনের ওপর ব্যক্তিগত নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হলে তা তাঁর জন্য ‘শাপে বর’ হতে পারে। তিনি রুশদের মধ্যে তাঁর জনপ্রিয়তা বাড়াতে এই নিষেধাজ্ঞার ইস্যুটিকে ব্যবহার করার সুযোগ পাবেন। বিবিসির কূটনৈতিক প্রতিবেদক জেমস ল্যান্ডালও এমনটাই মনে করেন। তাঁর মতে, পশ্চিমাদের ব্যক্তিগত নিষেধাজ্ঞা পুতিনকে তাঁর নিজ দেশে আরও জনপ্রিয় করে তুলতে পারে।

0Shares

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *