দ্য ব্ল্যাক উইডো

টেলিভিশন সাংবাদিক ইয়াসের উসমান হিন্দি চলচ্চিত্রের বেশ কয়েকজন কিংবদন্তি তারকার জীবনী লিখেছেন। রাজেশ খান্নাকে নিয়ে তার আগ্রহ না থাকলেও জীবনী ঠিকই লিখেছেন। বইটি প্রকাশিত হয় ২০১৪ সালে। একইভাবে ইয়াসের রেখার বড় ভক্ত না হলেও এই বহুল আলোচিত অভিনেত্রীর জীবনী লিখেছেন। তার রেখা: দি আনটোল্ড স্টোরি বইটি প্রকাশিত হয় ২০১৬ সালে। বইয়ের ভূমিকায় ইয়াসের লেখেন, ‘আমাকে বলতেই হবে যে আমি রেখার কোনো পাগল ভক্ত নই। আমি বেড়ে উঠেছি ১৯৮০-এর দশকে। তখন রেখার ক্যারিয়ার ভাটার দিকে। তবে সে দশকে তার কিছু পারফরম্যান্স আমার খুব ভালো লেগেছিল। তার সাক্ষাত্কারগুলো পড়তেও আমি খুব আগ্রহী থাকতাম।’

রেখার এসব সাক্ষাত্কারে থাকত তার জীবনের বোহেমিয়ান দর্শন, ব্যর্থ প্রেমের স্বীকারোক্তি, সহশিল্পীদের নিয়ে অনেকটা ত্যাছড়া মন্তব্য। উসমানের বইয়ের অনেকটা অংশজুড়ে আছে রেখার এসব সাক্ষাত্কার। বইয়ের জন্য অনেকবার চেষ্টা করেও ইয়াসের রেখার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে পারেননি। প্রতিবারই তাকে বিনয়ের সঙ্গে ফিরিয়ে দিয়েছেন রেখার অনুগত সেক্রেটারি ফারজানা। শেষমেশ রেখা: দি আনটোল্ড স্টোরি বইয়ের একটি অধ্যায়ই লেখা হয়েছে এই ফারজানাকে নিয়ে।

ব্যক্তি রেখাকে খুঁজতে ইয়াসেরকে তাই বারবার দারস্থ হতে হয়েছে তার ছাপা কণ্ঠ, মানে গণমাধ্যমে বিভিন্ন সময় প্রকাশিত সাক্ষাত্কারের।

১৯৮০ ও ৯০-এর দশকে ভারতের প্রভাবশালী ফিল্ম ম্যাগাজিন—স্টারডাস্ট, স্টার অ্যান্ড স্টাইল ও সুপারে নিয়মিত বিরতিতে রেখার সাক্ষাত্কার প্রকাশিত হতো। এসব সাক্ষাত্কারে রেখা অনেক চাঞ্চল্যকর কথা বলেছেন, যেমন প্রথম স্বামী বিনোদ মেহরাকে নিয়ে অজানা কথা, অমিতাভ বচ্চনের সঙ্গে সম্পর্ক, এমন আরো অনেক বিষয়।

রাজেশ খান্না ও রেখার জীবনী লিখতে কেন আগ্রহী হয়েছেন ইয়াসের উসমান? রেখা ও রাজেশ খান্নার ব্যক্তি জীবনের একাকিত্বই ইয়াসেরকে আকর্ষণ করেছিল। স্ক্রলডটইনকে দেয়া এক সাক্ষাত্কারে ইয়াসের বলেন, ‘দুটো জীবনীর একটি বিষয় সাধারণ—তাদের অন-স্ক্রিন জীবন আর ব্যক্তিগত একাকিত্ব একেবারে বিপরীত। তাদের দুজনের জীবনেই ভালোবাসা ছিল কিন্তু একই সঙ্গে তারা ছিলেন খুব একা। এ কারণেই আমি তাদের দুজনের জীবনী লিখেছি।’

উসমান তার মনোযোগ আকর্ষণকারী রেখার জীবনী শুরু করেছেন দিল্লির ব্যবসায়ী মুকেশ আগারওয়ালের সঙ্গে তার বিয়ে নিয়ে। বিয়েটা ছিল বড় ট্র্যাজেডি। বিয়ের সাত মাসের মাথায় ১৯৯০ সালের অক্টোবরে আত্মহত্যা করেন মুকেশ। কথিত আছে, রেখার ওড়না দিয়েই গলায় ফাঁস পরেছিলেন তিনি। এ ঘটনার এক মাস আগেই রেখা ও মুকেশ বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিলেন। মুকেশের আত্মহত্যা রেখার জীবনে বড় দুর্নাম বয়ে এনেছিল, তাকে অনেকে মানুষখেকো আখ্যা দিয়েছিলেন।

মুকেশের আত্মহত্যার পর পত্রপত্রিকাগুলো রেখাকে উদ্দেশ্য করে অসংখ্য চাঞ্চল্যকর প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল। সেসব প্রতিবেদনে যেসব শিরোনাম ব্যবহার করা হয়, তা শুনলে পাঠক আজও চমকে উঠবেন—‘দ্য ব্ল্যাক উইডো’ (শোটাইম, নভেম্বর, ১৯৯০) কিংবা ‘দ্য ম্যাকাব্রা ট্রুথ বিহাইন্ড মুকেশ’স সুইসাইড’ (সিনে ব্লিটজ, নভেম্বর, ১৯৯০)। দিল্লির ভদ্র সমাজ থেকে মুম্বাইয়ের ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি সবাই মুকেশকে ‘হত্যা’র দায়ে রেখাকে দোষীসাব্যস্ত করেছিল। পুত্রশোকে মুকেশের মায়ের করা একটি মন্তব্য পত্রিকার শিরোনাম হয়ে ওঠে, ‘ও ডায়েন মেরা বেটে কো খা গায়ি’ (ওই ডাইনি আমার ছেলেটাকে খেয়ে ফেলেছে)।

ইয়াসের উসমান বলেন, ‘এটা একটা ট্র্যাজিক গল্প। রেখা আজীবনের যোদ্ধা এবং শেষমেশ তিনি বিজয়ী হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন। কিন্তু বলিউড তার প্রতি নিষ্ঠুর ছিল।’

ইয়াসেরের মতে, ১৯৮০ নাগাদ অনেক বাধা অতিক্রম করে রেখা বলিউডের অন্যতম তারকায় পরিণত হন। কিন্তু কুখ্যাতিও তার পেছন ছাড়েনি। এর জন্য রেখার স্ক্যান্ডাল ছড়ানোর স্বভাবের চেয়ে চলচ্চিত্র দুনিয়ার নৈতিক ভণ্ডামি বেশি দায়ী।’

রেখা: দি আনটোল্ড স্টোরিতে ইয়াসের ভানুরেখার হিন্দি চলচ্চিত্র দুনিয়ার অন্যতম আলোচিত তারকা হয়ে ওঠার যাত্রাপথকে অনুসন্ধান করতে চেয়েছেন। রেখার ক্যারিয়ার শুরু হয়েছিল ১৪ বছর বয়সে, কন্নড় ও তামিল সিনেমায়। তার প্রথম হিন্দি সিনেমা ছিল আনজানা সফর (১৯৬৯)। ইয়াসেরে মতে, ১৯৭০ এবং ৮০-এর দশকে রেখা অনেক ছবিতে চরিত্র নির্বাচন, কস্টিউম ও অভিনয়ের দিকে যথেষ্ট মনোযোগ দেননি।

দুলাল গুহের দো আনজানে ছবির মধ্য দিয়ে রেখা প্রথমবারের মতো অমিতাভ বচ্চনের সঙ্গে কাজ করেন। ছবিতে রেখার অভিনয় প্রশংসিত হয়। বলতে গেলে এ ছবি থেকেই তাকে দক্ষ অভিনেত্রী হিসেবে মূল্যায়ন করা শুরু হয়। সিলসিলা ও মি. নটবরলাল ছিল এ জুটির তুমুল জনপ্রিয় দুটি ছবি। একই সঙ্গে ডালপালা মেলছিল অমিতাভ ও রেখার সম্পর্ক নিয়ে নানা গল্প। ইয়াসের একটি প্রশ্ন তুলেছেন। রেখাকে নিয়ে বেশ অনেক বছর ধরে মিডিয়ার যে নীরবতা, তার কারণ কি অমিতাভ বচ্চনের ইমেজ রক্ষা করা কিনা।

রেখার উমরাও জান (১৯৮১) ছবির পরিচালক ছিলেন মুজাফফর আলী। তার কথায়, ‘রেখা খুবই সংবেদনশীল নারী। দোষটা পুরোপুরি অমিতাভ বচ্চনের… রেখা অমিতাভকে ভালোবাসতো। অমিতাভের উচিত ছিল তাকে বিয়ে করা।’

সবশেষে রেখাকে নিয়ে ইয়াসেরের মন্তব্যটা এমন, ‘আমি বলছি না তিনি কোনো রোল মডেল। কিন্তু তিনি সবকিছুতেই সৎ ছিলেন। বলিউড তাকে বশ মানাতে চেয়েছে।’

0Shares

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *