তৃণমূলের ছোট নেতাদের দুষছে বিব্রত আ. লীগ

দেশের সংখ্যালঘু বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষের বেশির ভাগই আওয়ামী লীগকে সমর্থন করে—প্রচলিত এমন ধারণা বহু বছরের। কিন্তু সেই আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকার পরও গত এক দশকে বারবার সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার ঘটনা ঘটছে। এসব হামলার একাধিক ঘটনায় স্থানীয় আওয়ামী লীগ বা এর সহযোগী সংগঠনগুলোর নেতাকর্মীদের সম্পৃক্ততার তথ্য সামনে এসেছে। আর সবগুলো ঘটনাতেই যখন হামলা হয়েছে কিংবা মাইকিং করে হামলার প্রস্তুতি নিয়েছে, তখন তা থামাতে এগিয়ে আসেননি আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। অসাম্প্রদায়িক আদর্শের দল আওয়ামী লীগের তৃণমূলের নেতাকর্মীদের এমন ভূমিকায় বিব্রত কেন্দ্রীয় নীতিনির্ধারকরা।

দলটির কেন্দ্রীয় গুরুত্বপূর্ণ কয়েকজন নেতা বলেন, তৃণমূলের ছোট নেতারা নানা প্রলোভনে পড়ে বা ব্যক্তিস্বার্থ হাসিলে সাম্প্রদায়িক বিএনপি-জামায়াত-হেফাজতের সঙ্গে যুক্ত হয়ে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা চালান। তাঁরা হয়তো বুঝতেও পারেন না যে তাঁদের ওই ছোটোখাটো প্রলোভনে পড়ার খেসারত সরকারকে বাজেভাবে দিতে হয়। এসব ঘটনায় সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়। অনেক সময় আওয়ামী লীগে অনুপ্রবেশকারীরা দলকে বিতর্কিত করতে, সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর ষড়যন্ত্র বাস্তবায়ন করতে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা চালায়। আবার অনেক সময় সুকৌশলে ধর্মীয় উগ্রবাদীরা তৃণমূল আওয়ামী লীগ বা সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের হামলায় জড়িয়ে ফেলে। কিন্তু এসবের দায় এসে পড়ে আওয়ামী লীগের ওপরই। প্রশ্নবিদ্ধ হয় আওয়ামী লীগের দীর্ঘ বছরের অসাম্প্রদায়িক মতাদর্শ।

আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজী জাফর উল্যাহ বলেন, ‘এ হামলাগুলো ব্যক্তিস্বার্থের জন্যই হয়ে থাকে। এগুলো রাজনৈতিক কারণে ঘটছে না। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, সংখ্যালঘুদের জমি বা সম্পত্তি দখলের জন্য তাদের ওপর জুলুম করা হয়।’
[১] কোভিড-১৯: সরকারের কার্যক্রম পর্যালোচনায় বসছেন ৬ মন্ত্রী ≣ [১] করোনা ভ্যাকসিন বাজারে আসতে সময় লাগবে, ‘গুরুতর পরিণতি’ নিয়ে সিনেটকে সতর্ক করলেন ফাউসি ≣ জেনারেল মইন ইউ আহমেদের স্মৃতিচারণ, সেদিন মৃত্যুর প্রস্তুতি নিয়ে বঙ্গভবনে গিয়েছিলাম

আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ‘আওয়ামী লীগ এত বড় একটা দল যে একেবারে নিচের দিকে, মানে ওয়ার্ড পর্যায়ে সব সময় যাচাই-বাছাই করে নেতা নির্বাচন সম্ভব হয় না। ওই পর্যায়ে আমাদের অনেক পুরনো সচেতন নেতা যেমন আছে, তেমনি কিছু ত্রুটি-বিচ্যুতিসহ লোকজনও ঢুকে পড়েছে। আবার টানা ক্ষমতায় থাকার ফলে ভোটের জটিল সমীকরণ মেলাতে অনেক এলাকায় কিছু সুবিধাবাদী লোককেও আমাদের নেতারা দলে নিয়েছেন। এই অনুপ্রবেশকারী লোকগুলোর কাছে দলের চেয়ে তাদের নিজের স্বার্থ গুরুত্বপূর্ণ। এদের ছোট ছোট লোভ ও স্বার্থের কারণে আমরা বিব্রত হচ্ছি। তারাই নানাভাবে সাম্প্রদায়িক উগ্র গোষ্ঠীর সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়ছে। তবে দলগতভাবে আওয়ামী লীগ কখনোই সাম্প্রদায়িক কোনো গোষ্ঠীর সঙ্গে আপস করেনি। আমরা অসাম্প্রদায়িকতার নীতিতেই পথ চলব, ক্ষমতায় থাকলেও কিংবা না থাকলেও।’

আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম বলেন, ‘এ ধরনের হামলায় তৃণমূল আওয়ামী লীগের কোনো নেতা যুক্ত হয়ে পড়লে আমরা খুবই বিব্রত, লজ্জিত ও দুঃখিত হই। দলগতভাবে আওয়ামী লীগ কখনোই সাম্প্রদায়িক রাজনীতিতে বিশ্বাসী নয়। আমরা আদর্শিক বা নীতিগতভাবে কখনোই কোনো সাম্প্রদায়িক হামলা সমর্থন করি না। বিএনপি-জামায়াতই হলো সেই রাজনৈতিক শক্তি, যারা দলগতভাবে এবং ক্ষমতায় গেলে রাষ্ট্রীয়ভাবে সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস চালায়।’ তিনি বলেন, ‘আওয়ামী লীগের কোনো আদর্শবিচ্যুত নেতাকর্মী সাম্প্রদায়িক হামলায় যুক্ত হলে সরকার কঠোর ব্যবস্থা নিচ্ছে, ভবিষ্যতেও নেবে। আমরা সব সময়ই নিজেদের কোনো ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকলে সেগুলো সংশোধনের চেষ্টা করি। সাম্প্রদায়িক উগ্র গোষ্ঠী কোথাও যদি আগে থেকে মাইকিং করে জমায়েতের মাধ্যমে হামলার চেষ্টা করে, তবে প্রশাসন ও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের উচিত সেগুলো নস্যাৎ করে দিতে ভূমিকা রাখা।’

সুচিন্তা ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ এ আরাফাত বলেন, ‘আওয়ামী লীগ সাম্প্রদায়িক হয়ে গেছে, নাকি সাম্প্রদায়িক কিছু মানুষ আওয়ামী লীগে ঢুকে পড়েছে, সেটা আমাদের আগে বুঝতে হবে। কিছু সাম্প্রদায়িক মানুষ আওয়ামী লীগে ঢুকেছে নিঃসন্দেহে। কিন্তু এ দেশে সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী সবচেয়ে বেশি সোচ্চার দল এখনো আওয়ামী লীগ। দলটির নেতাদের দায়িত্ব হলো দলের ভেতরে-বাইরে সাম্প্রদায়িক মানুষগুলোর বিরুদ্ধে লড়াই করা।’

আওয়ামী লীগের সম্পাদকমণ্ডলীর দুজন সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ২০০৮ সালের নির্বাচনের পর থেকে গত ১২ বছরের বেশি সময় ধরে বিএনপি, জামায়াতসহ বিভিন্ন ইসলামী দলের নেতাকর্মীরা আওয়ামী লীগে ভিড়ছেন। বিশেষ করে ২০১৪ সালের নির্বাচনের পর সাম্প্রদায়িক রাজনীতিতে যুক্ত ছিলেন, এমন অনেকেই নানা কৌশলে আওয়ামী লীগে আশ্রয় নিয়েছেন। এক যুগ আগে যাঁরা আওয়ামী লীগে যুক্ত হয়েছেন, তাঁদের বেশির ভাগেরই এখন অতীতের দলীয় পরিচয় মুছে গেছে। তাঁরা অনেকেই তৃণমূলে আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতাকর্মী হয়ে উঠেছেন।

আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের মতে, বিভিন্ন দল থেকে আওয়ামী লীগে ভেড়া ওই সব নেতাকর্মীর দু-চারজন ছাড়া কেউই আদর্শিক কারণে দল পরিবর্তন করেননি। তাঁরা অনেকেই নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষায় এবং অন্য দলের এজেন্ডা বাস্তবায়নে আওয়ামী লীগ করছেন। এঁরা সুযোগ পেলেই আওয়ামী লীগকে বিতর্কিত করতে চেষ্টা করেন। আওয়ামী লীগের অনেক নেতা নিজের আধিপত্য ধরে রাখতে এসব অনুপ্রবেশকারীকে পৃষ্ঠপোষকতা দিচ্ছেন।

হামলার ঘটনায় আ. লীগ নেতাকর্মীদেরও নাম আসে

গত বুধবার সুনামগঞ্জের শাল্লায় সংখ্যালঘুদের বাড়িতে হামলার ঘটনায় মূল আসামি শহীদুল ইসলাম স্বাধীন ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য ও স্থানীয় ওয়ার্ড যুবলীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। হেফাজতে ইসলামের নেতা মামুনুল হকের বিরুদ্ধে ফেসবুক পোস্টের ছুতায় এই হামলার ঘটনায় স্বাধীন যুক্ত হন তাঁর ব্যক্তিস্বার্থের কারণে। জলমহাল নিয়ে হিন্দু সম্প্রদায়ের সঙ্গে বিরোধ চলছিল স্বাধীনের। ক্ষোভ মেটাতেই তিনি জড়িয়ে যান উগ্র সাম্প্রদায়িক হামলায়। অন্যদিকে হামলার দুই দিন আগে থেকেই উগ্র গোষ্ঠী নানা তৎপরতা চালায়। ঘটনার দিন সকালে মাইকিং করে জমায়েত হলেও হামলা থামাতে ব্যর্থ হয় প্রশাসন।

এর আগে ২০১৭ সালের ১০ নভেম্বর রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলার ঠাকুরপাড়ায় হিন্দুদের ঘরবাড়িতে হামলা হয়। ফেসবুকে ইসলাম ধর্ম নিয়ে কটূক্তির অভিযোগ তুলে এই হামলা চালানো হয়। হামলার আগে মানববন্ধনের ঘোষণা দিয়ে তিন-চার দিন এলাকায় মাইকিং করা হয়। ওই কর্মসূচিতে কয়েক হাজার মানুষ জমায়েত হয়ে হিন্দুপাড়ায় তাণ্ডব ও লুটপাট চালায়। পরে পুলিশের গুলিতে এক ব্যক্তি নিহত হন। ঠাকুরপাড়ায় হামলার আগে কয়েক দিন ধরে প্রস্তুতি চললেও হামলা থামাতে স্থানীয় প্রশাসন জোরালো ভূমিকা রাখেনি। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরাও গুজবের বিরুদ্ধে মানুষকে সচেতন করতে তৎপর হননি।

২০১৬ সালের ৩০ অক্টোবর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর বড় ধরনের হামলার ঘটনা ঘটে। ওই ঘটনায় দায়ের করা একটি মামলার সাক্ষী ও আসামিদের জবানবন্দিতে হামলায় নেতৃত্বদানকারী হিসেবে স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও বিএনপির কয়েকজন নেতার নাম উঠে আসে।

২০১২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর কক্সবাজারের রামুতে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের ওপর হামলা, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের ঘটনা ঘটে। রামুতে ১২টি বৌদ্ধ বিহার ও ৩০টি বসতবাড়ি এবং উখিয়া-টেকনাফে সাতটি বৌদ্ধ বিহার ও ১১টি বসতবাড়িতে হামলা হয়। এই হামলায় বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা অংশ নেন, তাঁদের মধ্যে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের বেশ কিছু নেতাকর্মীও ছিলেন বলে অভিযোগ ওঠে।

গত বছরের ৪ ডিসেম্বর কুষ্টিয়ার কুমারখালীর কয়া মহাবিদ্যালয়ে বাঘা যতীনের ভাস্কর্য ভাঙচুর করেন স্থানীয় কয়া ইউনিয়ন যুবলীগের সভাপতি আনিসুর রহমান। কলেজটির অধ্যক্ষের সঙ্গে দ্বন্দ্বে তাঁকে বেকায়দায় ফেলতেই এই ঘটনা ঘটান আনিসুর।

0Shares

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *