ডুবতে বসেছে বাংলাদেশ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়

শিক্ষক-কর্মকর্তাদের আট মাসের বেতন বকেয়া। দুই বছরের বেশি সময় ধরে পদোন্নতি, বেতন বৃদ্ধি ও প্রভিডেন্ট ফান্ড সুবিধা বন্ধ। বেতন-ভাতা, বিল ও ঋণ বাবদ বিশ্ববিদ্যালয়টির দায়ের পরিমাণ ৩৫ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। সংরক্ষিত তহবিলে ৫ কোটি টাকা থাকার কথা থাকলেও সেটিও নেই। আর্থিক এ দুরবস্থার চিত্র বেসরকারি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের। শুধু আর্থিক নয়; বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষার্থী সংকটও প্রকট। কর্তৃপক্ষের অব্যবস্থাপনা ও যুগোপযোগী বিষয় না থাকায় এক দশকের ব্যবধানে বিশ্ববিদ্যালয়টিতে শিক্ষার্থী সংখ্যা কমেছে ৭৫-৮০ শতাংশের বেশি। পরতে পরতে অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনার কারণে ডুবতে বসেছে বেসরকারি এ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।

শিক্ষক-কর্মকর্তাদের অভিযোগ, অবৈধভাবে আর্থিকসহ নানা সুবিধা নিলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়নে কোনো উদ্যোগ নেননি দেখভালের দায়িত্বে থাকা বোর্ড অব ট্রাস্টিজ (বিওটি) সদস্যরা। বিওটি চেয়ারম্যানসহ কয়েকজন সদস্যের অনিয়ম, অবহেলা ও অব্যবস্থাপনাই বিশ্ববিদ্যালয়কে দুর্দশার দিকে ঠেলে দিয়েছে।

বাংলাদেশ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের বিওটির চেয়ারম্যান অধ্যাপক কামালউদ্দীন আবদুল্লাহ জাফরী। তিনি বিশ্ববিদ্যালয় তহবিল থেকে মাসে ৩ লাখ ৮০ হাজার টাকা করে সম্মানী নেন, যেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান নির্বাহীর দায়িত্বে থাকা ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য এর অর্ধেক পরিমাণ বেতনও পান না। যদিও ট্রাস্টি হিসেবে কোনো আর্থিক সুবিধাই নিতে পারেন না বিওটি চেয়ারম্যান। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গাড়ি, গাড়ির চালক, আবাসন ও একাধিক কর্মচারীসহ নানা সুবিধা নিচ্ছেন কামালউদ্দীন জাফরী।

এ প্রসঙ্গে জানতে বিশ্ববিদ্যালয়টির বিওটি চেয়ারম্যান কামালউদ্দীন জাফরীর কার্যালয়ে তিনদিন গিয়েও তাকে পাওয়া যায়নি। সেলফোনের মাধ্যমে দুবার কথা হলেও তিনি এ বিষয়ে কথা বলতে সম্মত হননি। তবে বিওটি চেয়ারম্যানের আর্থিক সুবিধা নেয়ার বিষয়টি স্বীকার করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়টির ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য ও কোষাধ্যক্ষ কাজী আখতার হোসেন। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, বিওটি চেয়ারম্যান মাসে ৪ লাখ টাকার মতো সম্মানী নেন। তবে আর্থিক সংকটের কারণে শিক্ষক-কর্মকর্তাদের মতো বিওটি চেয়ারম্যানের সম্মানীও বকেয়া রয়েছে।

বিওটির মেম্বার সেক্রেটারি হিসেবে রয়েছেন কামালউদ্দীন জাফরীর ভাই সৈয়দ শহীদুল বারী। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের পরিচালকের পদটিও তার দখলে। অভিযোগ রয়েছে, নিয়মিত অফিস না করেও মাসে ১ লাখ টাকার বেশি আর্থিক সুবিধা নেন শহীদুল বারী। এমনকি মাসের পর মাস বিদেশে অবস্থান করেও নিয়মিত বেতন নিয়েছেন তিনি। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের এসি খুলে নিজের বাসায় নিয়ে লাগিয়েছেন শহীদুল বারী—শিক্ষক-কর্মকর্তাদের মুখে মুখে এমন একটি কথাও শোনা যায়।

একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, তহবিল থেকে নানা সুবিধা নিলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়নে শহীদুল বারী কোনো উদ্যোগ বা পরিকল্পনা নেননি। ট্রাস্টের মেম্বার সেক্রেটারি হিসেবে তার উচিত ছিল বিওটি চেয়ারম্যানকে ভালো পরামর্শ দেয়া। তিনি এতে ব্যর্থ হয়েছেন। উল্টো শিক্ষক-কর্মকর্তাদের পক্ষ থেকে ভালো কোনো প্রস্তাব এলে তাও থামিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছেন। আসলে বিশ্ববিদ্যালয়ের আজকের এ সংকট সৃষ্টির মূল কারণ হলো দক্ষ ও যোগ্য প্রশাসক না থাকা।

এসব অভিযোগ বিষয়ে জানতে চাইলে শহীদুল বারী বলেন, অনৈতিকভাবে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কোনো ধরনের আর্থিক সুবিধা নিইনি। আর প্রতিষ্ঠানের জন্য কী অবদান রেখেছি, সেটি বিওটি চেয়ারম্যানই ভালো বলতে পারবেন।

বিওটি চেয়ারম্যানের ছেলে সৈয়দ আম্মার বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ অ্যাসিস্ট্যান্ট (সুপারভাইজার) হিসেবে কাজ করছেন। ঢাকার বাইরে অবস্থান করেই বছরের পর বছর বিশ্ববিদ্যালয় তহবিল থেকে নিয়মিত বেতন নিচ্ছেন তিনি। এছাড়া জনসংযোগ কর্মকর্তাসহ বিশ্ববিদ্যালয়টির বিভিন্ন একাডেমিক ও প্রশাসনিক পদে বিওটি চেয়ারম্যানের আত্মীয়স্বজন কর্মরত রয়েছেন।

কষ্টে রয়েছেন শিক্ষক-কর্মকর্তারা: মাসের পর মাস বেতন-ভাতা পাচ্ছেন না শিক্ষক-কর্মকর্তারা। পরীক্ষা গ্রহণ, পরীক্ষার খাতা মূল্যায়নসহ বিভিন্ন কাজের বিলও দেয়া হচ্ছে না। সব মিলিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কোনো ধরনের আর্থিক সুবিধাই পাচ্ছেন না তারা। উল্টো শিক্ষক-কর্মকর্তাদের প্রভিডেন্ট ফান্ড থেকে পৌনে ২ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। কয়েক মাস আগে শিক্ষক-কর্মকর্তাদের প্রভিডেন্ট সুবিধাও বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। দুই বছরের বেশি সময় ধরে পদোন্নতি ও বেতন বৃদ্ধিও বন্ধ রাখা হয়েছে।

বিশ্ববিদ্যালয়টিতে বর্তমানে ৬২ জন শিক্ষক কর্মরত। চলমান সংকট বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন আর্থিক সংকটের বিষয়টিকে করোনার সঙ্গে মেলানোর চেষ্টা করছে। আসলে বিষয়টি তেমন নয়। করোনার অনেক আগে থেকেই এ সংকট চলছে। প্রভিডেন্ট সুবিধা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। বন্ধ করার আগে দেড় বছর আমাদের বেতন থেকে প্রভিডেন্ট ফান্ডের জন্য টাকা কাটা হলেও সেটি ফান্ডে জমা দেয়া হয়নি। এটি বড় ধরনের প্রতারণা। এছাড়া পদোন্নতি ও বেতন বৃদ্ধি বন্ধ থাকায় আমরা কোনো ধরনের উৎসাহ পাচ্ছি না।

একজন কর্মকর্তা বলেন, আট মাস বেতন বন্ধ থাকলে একটি মানুষ কীভাবে সংসারের খরচ মেটাবেন। এখন এমন একটা অবস্থা, চাকরি ছেড়ে গেলেও পাওনা পরিশোধ করার আর্থিক সক্ষমতাও নেই বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের।

এদিকে অর্থ সংকটের কারণে চাকরিচ্যুত করা হচ্ছে শিক্ষক-কর্মকর্তাদের। ২০১৯ সালের আগস্টে ১০ জন শিক্ষককে বাধ্যতামূলক অব্যাহতি দেয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। চাকরিচ্যুত শিক্ষকদের একটি অংশ এর প্রতিকার চেয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনে (ইউজিসি) অভিযোগ জমা দেয়। এ ঘটনায় একটি তদন্তও পরিচালনা করছে ইউজিসি।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ইউজিসি সদস্য অধ্যাপক ড. বিশ্বজিৎ চন্দ বণিক বার্তাকে বলেন, সম্প্রতি শিক্ষকদের চাকরিচ্যুত করার ঘটনা তদন্ত করতে গিয়ে ট্রাস্টি চেয়ারম্যান ও তার পরিবারের সদস্যদের বিভিন্ন অবৈধ সুবিধা গ্রহণের বিষয়টি আমাদের নজরে এসেছে। বিশেষ করে বিওটি চেয়ারম্যান মাসে ৩ লাখ ৮০ হাজার টাকা সম্মানী হিসেবে নেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। বিওটি চেয়ারম্যানের আত্মীয়স্বজন অফিস না করেও মাসের পর মাস বেতন নিচ্ছেন। যদি এ অভিযোগগুলো সত্য হয় তাহলে অবশ্যই তাদের কাছ থেকে এসব অর্থ বিশ্ববিদ্যালয় তহবিলে ফেরত আনার ব্যবস্থা নেয়া হবে। অন্যথায় আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ভবন নির্মাণেও অনিয়ম: ঢাকার মুগদা এলাকার মান্ডায় গ্রিন মডেল টাউনে বাংলাদেশ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থায়ী ক্যাম্পাস গড়ে তোলা হয়েছে। কয়েক বছর আগে ওই ক্যাম্পাসে একটি ভবন নির্মাণ করা হয়। যদিও নির্মাণের সময় ভবনটির নকশা রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের অনুমোদন নেয়া হয়নি। ভবনটি নির্মাণের কাজ বিওটি চেয়ারম্যানের একজন আত্মীয়কে দেয়া হয়। ভবন নির্মাণেও অনিয়মের অভিযোগ তুলেছেন শিক্ষক-কর্মকর্তারা। এ প্রসঙ্গে একজন শিক্ষক বলেন, মাত্র দু-তিন বছর আগে ভবনটি নির্মাণ করা হয়েছে। অথচ এখনই বিভিন্ন জায়গায় ফাটল দেখা গেছে। বিশেষ করে ৩০০৫ নম্বর কক্ষসহ বিভিন্ন জায়গায় এরই মধ্যে কয়েকবার সংস্কার করার প্রয়োজন হয়েছে। এছাড়া এর আগে একটি টিনশেড নির্মাণ করা হয়েছিল। সেখানেও বড় ধরনের আর্থিক অনিয়ম হয়েছে।

শিক্ষার্থী কমেছে ৭০-৮০ শতাংশ: ২০০৫ সালে প্রতিষ্ঠার পর খুব অল্প সময়ের মধ্যেই জনপ্রিয়তা পায় বাংলাদেশ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়। ২০১০-১১ সালের দিকে বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল প্রায় ১০ হাজার। যদিও বিশ্ববিদ্যালয়টিতে বর্তমানে শিক্ষার্থী সংখ্যা কমে ২ হাজার ২০০-তে দাঁড়িয়েছে।

শিক্ষার্থী হারানোর ক্ষেত্রে যুগোপযোগী বিভাগ না থাকাকে দায়ী করেছেন অনেক শিক্ষক। চারটি বিভাগ নিয়ে যাত্রা করে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়। বিভাগগুলো হলো বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন, ইমলামিক স্টাডিজ, আইন ও ইংরেজি। এরপর আর কোনো নতুন বিভাগ চালু করতে পারেনি বাংলাদেশ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়। অনুমোদন ছাড়াই সংরক্ষিত তহবিলের অর্থ খরচ করাসহ বিভিন্ন অনিয়মের কারণে নতুন কোনো বিভাগের অনুমোদন দেয়নি ইউজিসি।

আর্থিক অনিয়মের পাশাপাশি একাডেমিক কার্যক্রমেও অনিয়ম করেছে বিশ্ববিদ্যালয়টি। আইন বিভাগে আসনের অতিরিক্ত ভর্তি করানোর কারণে বেকায়দায় পড়েছেন শিক্ষার্থীরা। সম্প্রতি এর প্রতিবাদে বিশ্ববিদ্যালয়ে তালাও দিয়েছেন ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীরা। এছাড়া আর্থিক সংকটের মধ্যেই আইন বিভাগের অনিয়মের কারণে আদালতের নির্দেশে ২০-৩০ লাখ টাকা জরিমানা গুনতে হয়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটিকে।

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার আবদুল মোনাফ পাটওয়ারী বলেন, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের আয়ের একমাত্র উৎস শিক্ষার্থীদের টিউশন ফি। অস্থায়ী ক্যাম্পাস থেকে স্থায়ী ক্যাম্পাসে আসার কারণে শিক্ষার্থীর সংখ্যা অনেক কমে গেছে। করোনার কারণে সে সংকট আরো বেড়েছে। এছাড়া শিক্ষার্থীদের কাছে ২ কোটি টাকার বেশি টিউশন ফি বকেয়া রয়েছে। এখন সরকারি বা বেসরকারি প্রণোদনা পেলে বিশ্ববিদ্যালয়টির পক্ষে ঘুরে দাঁড়ানো সম্ভব।

0Shares

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *