ডাক দিয়াছেন দয়াল…

বাংলাদেশের সংগীতজগতে তাকে ধ্রুবতারাই বলা চলে। প্রায় সব ধরনের গান গেয়েছেন। চ্যালেঞ্জ নিয়েছেন। তার ফলও পেয়েছেন। সংগীতজগতও তাকে দুহাত ভরে দিয়েছে।‘প্লেব্যাক সম্রাট’ খেতাব পেয়েছেন, আটবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার ছাড়াও আরো অসংখ্য পুরস্কার পেয়েছেন। তবে সবচেয়ে বেশি যেটা পেয়েছেন সেটা সাধারণ মানুষের ভালোবাসা। সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, প্রেম-বিরহ, ফোক, রকসহ প্রায় সব ধরনের গান গাওয়ায় সব শ্রেণীর শ্রোতার কাছ থেকে অপরিসীম ভালোবাসা পেয়েছেন।

১৯৫৫ সালের ৪ নভেম্বর রাজশাহীতে জন্মগ্রহণ করেন কিংবদন্তি এ শিল্পী। রাজশাহীর আলো-বাতাসেই বেড়ে উঠেছেন। এমনকি পড়াশোনাও করেছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। রাজশাহীর একজন থেকে দেশের একজন হয়ে ওঠার এ পথচলা শুরু হয়েছিল সেই ছোটবেলা থেকেই। অল্প বয়সেই শুরু করেন গানের তালিম নেয়া। এন্ড্রু কিশোর প্রথম দিকে আবদুল আজিজ বাচ্চুর কাছে সংগীতের পাঠ শুরু করেন। দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের পর তিনি নজরুল, রবীন্দ্রনাথ, আধুনিক, লোকগান, দেশাত্মবোধকসহ প্রায় সব ধারার গানে রাজশাহী বেতারে তালিকাভুক্ত হন।

বেতারশিল্পী থেকে চলচ্চিত্রের দুনিয়ায় পথচলা শুরু গত শতাব্দীর সত্তরের দশকে। ১৯৭৭ সালে শিবলী সাদিকের পরিচালনায় ‘মেইল ট্রেন’ ছবিতে ‘অচিনপুরের রাজকুমারী নেই যে তার কেউ’ গানের মাধ্যমে চলচ্চিত্রে তার অভিষেক ঘটে। চলচ্চিত্রে এটাই তার প্রথম গান হলেও মুক্তি পাওয়ার দিক থেকে ‘প্রতিজ্ঞা’ ছবির ‘এক চোর যায় চলে’ গানটি আগে মুক্তি পায়। দুটি ছবিতেই সুরকার ও সংগীত পরিচালক ছিলেন আলম খান। মূলত আলম খানের হাত ধরেই চলচ্চিত্রে পরিচিত হয়ে ওঠেন এন্ড্রু কিশোর।

তার গানগুলোতে প্রেম-ভালোবাসার কথাগুলোই বেশি উচ্চারিত হয়েছে। ‘আমার বুকের মধ্যিখানে/ মন যেখানে হূদয় যেখানে’, ‘ভালো আছি ভালো থেকো/ আকাশের ঠিকানায় চিঠি লিখো’, ‘তুমি মোর জীবনের ভাবনা/ হূদয়ে সুখের দোলা’, ‘তোমায় দেখলে মনে হয়’, ‘পড়ে না চোখের পলক’ গানগুলো এখনো প্রেমিক হূদয়ে নাড়া দেবেই। তার গাওয়া বিরহের গানগুলোই বা কম কিসে? ‘আমার সারা দেহ খেয়ো গো মাটি/ এই চোখ দুটো মাটি খেয়ো না’, ‘ভালোবেসে গেলাম শুধু/ ভালোবাসা পেলাম না’, ‘তুমি বন্ধু আমার চির সুখে থেকো’ গানগুলোও সমানভাবে জনপ্রিয়। আবার তার গাওয়া ‘ডাক দিয়াছেন দয়াল আমারে’, ‘হায়রে মানুষ, রঙিন ফানুস’ ‘মনে কয় গাঁয়ে ফিরে যাই’ ফোক গানগুলোও জনপ্রিয় এখনো।

তার ‘বেদের মেয়ে জ্যোত্স্না’ গানটার কথা মনে আছে? ‘ডাক দিয়াছেন দয়াল আমারে’ গানের মাধ্যমে বাংলাদেশ ও ভারত উভয় দেশেই বাংলা ভাষাভাষী মানুষের কাছে পরিচিতি পেয়েছেন। আর তুমুল জনপ্রিয়তা পেয়েছেন ‘বেদের মেয়ে জ্যোত্স্না’ গানটার মাধ্যমে। আশির দশকেই এমন বেশকিছু হিট গান উপহার দিয়ে নব্বইয়ের দশক ও একুশ শতকে বাংলা চলচ্চিত্রের প্লেব্যাক জগতের এক অপরিহার্য নাম হয়ে ওঠেন। জীবনের বেশির ভাগ সময়ে মূলত চলচ্চিত্রে গান করেই কাটিয়েছেন। চলচ্চিত্রজগতে এতটাই ব্যস্ত ছিলেন যে অন্যান্য শিল্পীর মতো একক অ্যালবামের বাজারে তেমন তাকে দেখাই যায়নি। তবে হানিফ সংকেতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব থাকায় বেশ কয়েকবার চলচ্চিত্রের বাইরে এসে ‘ইত্যাদি’-তে গান করেছেন।

শুধু দর্শকদের ভালোবাসা পেয়েছেন এমনই নয়। সংগীত পরিচালক, সংগীত লেখক ও সুরকারদেরও ভালোবাসায় সিক্ত হয়েছেন তিনি। আলম খানের সঙ্গে অসংখ্য হিট গান উপহার দিয়েছেন। আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল, আলাউদ্দিন আলীসহ নামকরা অনেক সংগীত পরিচালকের সঙ্গে কাজ করেছেন। এমনকি সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক মৃত্যুশয্যায় যে গানগুলো লিখেছেন, সেগুলোও এন্ড্রু কিশোরকে গাওয়ার জন্য দিয়ে গিয়েছিলেন। শ্রোতা, সংগীত পরিচালক আর চলচ্চিত্র অঙ্গনের সবার এত ভালোবাসা পেয়েছেন মূলত গানের প্রতি তার ভালোবাসার পাশাপাশি পেশাদারিত্বও বজায় রাখার কারণে। তার বিনয়ী আচরণ, প্রতিনিয়ত চ্যালেঞ্জ নেয়া আর কঠোর পরিশ্রমই তাকে পরিচিত করে তুলেছিল গানের দুনিয়ায়।

বাংলাদেশের একমাত্র সংগীতশিল্পী হিসেবে তার সৌভাগ্য হয়েছে উপমহাদেশের অন্যতম সংগীত পরিচালক আরডি বর্মণের সঙ্গে কাজ করার। আরডি বর্মণ তাকে হিন্দি চলচ্চিত্রে কাজ করার জন্য মুম্বাইতেই থেকে যেতে বলেছিলেন। তবে নম্রতার সঙ্গে এন্ড্রু কিশোর জবাব দিয়েছিলেন, বাংলাদেশেই ভালো আছেন। নিজের দেশ ও নিজ দেশের সংগীতের প্রতি অপরিসীম টান না থাকলে এমন লোভনীয় প্রস্তাব ফিরিয়ে দেয়া সহজ কোনো ব্যাপার ছিল না।

জীবনের শেষ মুহূর্তে সিঙ্গাপুরে চিকিৎসা নেয়ার সময়ই হয়তো বুঝতে পেরেছিলেন, দয়ালের ডাক পড়ে গেছে। সেজন্যই দেশে ফেরার জন্য এমন ব্যাকুল হয়ে উঠেছিলেন। যেখান থেকে শুরু সেই রাজশাহীতেই শেষ করেছেন জীবনের পাঠ। চাইলেই তিনি সিঙ্গাপুরে উন্নত চিকিৎসা চালিয়ে যেতে পারতেন। তবে নিজ দেশের প্রতি টান থাকায় জীবনের অন্তিম মুহূর্তে নিজ জন্মভূমিতেই থাকতে চেয়েছেন।

ডাক দিয়াছেন গানেরই একটি চমত্কার লাইনের সঙ্গে তার জীবনকাহিনী মিলে যায়। ‘আমি চলতি পথে দুদিন থামিলাম, ভালোবাসার মালাখানি গলে পরিলাম’ কথাগুলোর মতো আসলেই তিনি ভালোবাসার মালা গলায় পরতে পেরেছিলেন। কতজন শিল্পীর কপালে এমন ভালোবাসা জোটে? ‘ভুলো না আমায়’ ছবিতে গাওয়া তার গান ‘আমি তো একদিন চলে যাবো/ বেঁধে রাখা যাবে না’ গানটা হঠাৎ করেই খুব মনে পড়ছে। কত সুন্দর করে গানের সুরে নিজের বিদায় আর সবাইকে ভালোবাসার বার্তা দিয়ে গেছেন।

তার গাওয়া ‘কভু যদি পাখির গান থেমে যায়/ আকাশ কি দেবে বিদায়?’ গানের কথাগুলো ধরে পুরো বাংলাদেশ আজ বলতে পারে, শুধু আকাশ নয়, বাংলা ভাষাভাষী সবার ভালোবাসা নিয়েই বিদায় নিয়েছেন তিনি। তবে এ বিদায় তার শারীরিক বিদায় শুধু। সংগীতজগতকে যা দিয়ে গেছেন, কালজয়ী যেসব গান রেখে গেছেন, তার মাধ্যমে বেঁচে থাকবেন একজন এন্ড্রু কিশোর।

0Shares

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *