ছয় দশকের নাটকীয় উত্থান-পতনের গল্প

ইউরোর মাধ্যমে অর্থনৈতিক জোট থেকে অভিবাসন সংকট এবং তারপর এল ব্রেক্সিট। ছয় দশকে উত্থান-পতনের নাটকীয় এক সময় পার করেছে আজকের ইউরোপীয় ইউনিয়ন। শুরু থেকে এখন পর্যন্ত কেমন ছিল সেই যাত্রা দেখে নেয়া যাক এক ঝলকে।

ইউরোপিয়ান ব্লকের জন্ম

১৯৫০ সালের মে মাসে ফরাসি পররাষ্ট্রমন্ত্রী রবার্ট শুম্যান ফ্রান্স এবং পশ্চিম জার্মানির মধ্যকার অর্থনৈতিক ইউনিয়নের প্রস্তাব উত্থাপন করেন। এক বছর পর বেলজিয়াম, ফ্রান্স, পশ্চিম জার্মানি, ইতালি, লুক্সেমবার্গ এবং নেদারল্যান্ডস মিলে ইউরোপীয় কয়লা ও ইস্পাত কমিউনিটি গঠন করে।

ইইউর পথে যাত্রা

১৯৫৭ সালের ২৫ মার্চ সেই একই ছয়টি দেশ রোম চুক্তিতে স্বাক্ষর করে, যা কিনা ইউরোপিয়ান ইকোনমিক কমিউনিটির (ইইসি) জন্য একটি সাধারণ বাজার প্রতিষ্ঠা করে।

এক বছর পর ইইসি কার্যকর হয়, যেখানে গুরুত্বপূর্ণ কিছু ইউরোপীয় প্রতিষ্ঠান তৈরি হয়। সেগুলো হলো মন্ত্রিপরিষদ, কার্যনির্বাহী সংস্থা ইউরোপিয়ান কমিশন এবং পার্লামেন্টারি অ্যাসেম্বলি, যা পরে ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টে পরিণত হয়।

প্রত্যক্ষ ভোটাধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে প্রথম সংসদীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৭৯ সালে। ব্রিটেন, ডেনমার্ক ও আয়ারল্যান্ড ইইসিতে যোগ দেয় ১ জানুয়ারি ১৯৭৩ সালে। এরপর গ্রিস আসে ১৯৮১ সালে, পর্তুগাল ও স্পেন যোগ দেয় ১৯৮৬ সালে। এছাড়া অস্ট্রিয়া, ফিনল্যান্ড ও সুইডেন ১৯৯৫ সালে ইইসির সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়। এরপর ১৯৯২ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি গিয়ে ম্যাসট্রিক্ট চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, যা ইউরোপে একক মুদ্রার ভিত্তিপ্রস্তরও স্থাপন করে দেয়। যার ধারাবাহিকতায় ১৯৯৩ সালের ১ নভেম্বর ইইসি রূপান্তরিত হয় ইউরোপীয় ইউনিয়নে।

ইউরো এবং বিস্তৃতি

ইউরো ব্যাংকনোট এবং মুদ্রা ১ জানুয়ারি ২০০২ সালে ১২টি দেশে প্রচলিত হয়, যা কিনা ডাচমার্ক, ফ্রাঙ্ক, লিরা ও পেসেতার মতো দেশীয় মুদ্রাগুলোর জায়গা দখল করে। যদিও ব্রিটেন, ডেনমার্ক এবং সুইডেন নিজেদের মুদ্রা অব্যাহত রাখার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এরপর ১ মে ২০০৪ সালে ইউরো ব্যবহারকারী দেশের সংখ্যা গিয়ে দাঁড়ায় ২৫টিতে। যেখানে সাইপ্রাস, চেক প্রজাতন্ত্র, এস্তোনিয়া, হাঙ্গেরি, লাটভিয়া, লিথুনিয়া, মাল্টা, পোল্যান্ড, স্লোভাকিয়া এবং স্লোভেনিয়াও ইউরো গ্রহণ করে। বুলগেরিয়া ও রোমানিয়া যোগ দেয় ২০০৭ সালে এবং ২০১৩ সালে ২৮তম দেশ হিসেবে যোগ দেয় ক্রোয়েশিয়াও।

সংকট

২০০৫ সালে ফরাসি ভোটাররা লিসবন চুক্তিতে প্রস্তাবিত ইউরোপিয়ান সংবিধানের একটি খসড়া প্রত্যাখ্যানের পর সংকটের মেঘ ঘনীভূত হয়। তিনদিন পর একই সিদ্ধান্তের পথে হাঁটে ডাচ ভোটাররাও। ২০০৯ সালে গিয়ে ইউরোপীয় নেতারা চুক্তিটি অনুমোদনের উদ্যোগ নেন, যা মূলত বর্ধিত ইউ প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যকারিতা উন্নয়নের মাধ্যমে করা হয়।

২০০৯ সালে এথেন্স ব্যয় ঘাটতির কথা জানায়। এরপর আরো কিছু দেশে অর্থনৈতিক সংকট ছড়িয়ে পড়ে। যেখানে গ্রিসের পর আয়ারল্যান্ড, পর্তুগাল, স্পেন ও সাইপ্রাস ইইউ থেকে সহায়তা খোঁজে। অর্থনৈতিক সংকটের উত্থানের সঙ্গে ইউরোপ বড় ধাক্কা খায় হাজারো অভিবাসীর আশ্রয় খোঁজার মাধ্যমে। ২০১৫ সালে যা ১০ লাখের চূড়া স্পর্শ করে। এ ক্ষেত্রটিতে ইইউ নেতারা যৌথভাবে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণে ব্যর্থ হয়।

ব্রেক্সিট ঝড়

ইউনিয়নের জন্য সবচেয়ে বড় ঝড়টি আসে ২৩ জুন ২০১৬ সালে। যেখানে ব্রিটেনে ৫২ শতাংশ ভোট আসে ইইউ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পক্ষে। এরপর দীর্ঘ সময় ধরে বিচ্ছেদের শর্ত নিয়ে চলে মতবিরোধ। যে ধারাবাহিকতায় ৩১ জানুয়ারি ২০২০ সালে প্রথম দেশ ইইউ থেকে বেরিয়ে যায় ব্রিটেন। ২৪ ডিসেম্বর ব্রেক্সিট উত্তর বাণিজ্য চুক্তিতেও ঐকমত্য পোষণ করে ইইউ ও ব্রিটেন। টানজিশন পিরিয়ডের যে সময় ছিল তা আজ শেষ হয়ে যাচ্ছে।

0Shares

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *