বিশ্বের সবচেয়ে বৃহৎ স্মার্টফোন বাজার চীন। নভেল করোনাভাইরাসের কারণে সৃষ্ট কভিড-১৯ মহামারীর কারণে তৃতীয় প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) দেশটিতে স্মার্টফোন সরবরাহ ৮ কোটি ৪৮ লাখ ইউনিটে দাঁড়িয়েছে, যা গত বছরের একই প্রান্তিকের চেয়ে ১৪ দশমিক ৩ শতাংশ কম। বাজার গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল ডাটা করপোরেশন (আইডিসি) প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এমন তথ্যই উঠে এসেছে। খবর ইন্দো-এশিয়ান নিউজ সার্ভিস।
আইডিসির প্রতিবেদন অনুযায়ী, চীনের স্মার্টফোন বাজারে ৪১ দশমিক ৪ শতাংশ দখলে নিয়ে শীর্ষ অবস্থানে রয়েছে হুয়াওয়ে। যদিও কভিড-১৯ মহামারীর কারণে গত প্রান্তিকে কিছু প্রিমিয়াম স্মার্টফোন মডেলের উৎপাদন হ্রাস করেছিল প্রতিষ্ঠানটি। তবে অনলাইন চ্যানেলের মাধ্যমে সরবরাহ লক্ষ্যমাত্রা পূরণে সক্ষম হয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।
এ বিষয়ে আইডিসির এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলের ক্লায়েন্ট ডিভাইস বিভাগের রিসার্চ ব্যবস্থাপক উইল ওং বলেন, যুক্তরাষ্ট্র-চীনের মধ্যে চলমান বাণিজ্য বিরোধের সবচেয়ে বড় ভুক্তভোগী প্রতিষ্ঠান হুয়াওয়ে। নেটওয়ার্ক সরঞ্জামের নিরাপত্তা দুর্বলতার অভিযোগে হুয়াওয়ের ওপর বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে মার্কিন বিচার বিভাগ। একই সঙ্গে প্রতিষ্ঠানটিকে কালো তালিকাভুক্ত করা হয়। গত আগস্টে হুয়াওয়ের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরো জোরালো করা হয়, যা বৈশ্বিক বাজারে হুয়াওয়ের ডিভাইস ব্যবসায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। মার্কিন নিষেধাজ্ঞার কারণে বৈশ্বিক স্মার্টফোন বাজারে খারাপ পরিস্থিতির মধ্যে পড়লেও চীনের গ্রাহকদের জোরালো সমর্থন পেয়েছে প্রতিষ্ঠানটি, যা গত প্রান্তিকে স্থানীয় বাজারে ডিভাইস সরবরাহ লক্ষ্যমাত্রা পূরণে ইতিবাচক ভূমিকা রেখেছে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে চীনের স্মার্টফোন বাজারের ১৭ দশমিক ৮ শতাংশ দখলে নিয়ে দ্বিতীয় শীর্ষ অবস্থানে জায়গা করে নিয়েছে ভিভো। বিভিন্ন গ্রাহক সেগমেন্টকে লক্ষ্য করে ডিভাইস উন্মোচন স্থানীয় বাজারে প্রতিষ্ঠানটির বাজার দখল বাড়াতে ভূমিকা রেখেছে। তবে জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে এক বছর আগের একই সময়ের চেয়ে ভিভোর স্মার্টফোন সরবরাহ কিছুটা কমেছে। ভিভো ৩০০ ডলার দামের ‘ওয়াই’ সিরিজের ফাইভজি ফোন দিয়ে চীনে অবস্থান দৃঢ় করতে চেষ্টা চালাচ্ছে। একই সঙ্গে ‘এক্স’ সিরিজের ফ্ল্যাগশিপ ডিভাইস সরবরাহ বাড়াতে জোর দিচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি।
চীনের স্মার্টফোন বাজারের ১৬ দশমিক ৬ শতাংশ দখলে নিয়ে তৃতীয় শীর্ষ অবস্থানে রয়েছে অপো। এ প্রতিষ্ঠানটি ২০০ থেকে ৪০০ ডলার মূল্যের ফাইভজি ফোন দিয়ে বাজার আধিপত্য বাড়ানোর কৌশল নিয়ে এগোচ্ছে। তবে গত প্রান্তিকে এক বছর আগের একই সময়ের চেয়ে অপোর ডিভাইস সরবরাহেও কিছুটা ঘাটতি দেখা গেছে।
অন্যদিকে শাওমি বিশ্বের অনেক বাজারে ভালো ব্যবসা করছে। তবে চীনের বাজারের ১৩ শতাংশ দখলে নিয়ে চতুর্থ অবস্থানে রয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। মার্কিন প্রযুক্তি কোম্পানি অ্যাপল চীনের বাজারের ৮ দশমিক ৩ শতাংশ দখলে নিয়ে পঞ্চম অবস্থানে রয়েছে।
চীন নভেল করোনাভাইরাসের উত্পত্তিস্থল। গত বছর ডিসেম্বরের শেষদিকে দেশটিতে প্রথম করোনা আক্রান্ত শনাক্ত করা হয়। এর ভাইরাসটি দ্রুত বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়েছিল। ভাইরাসটির আতঙ্কে চলতি বছরের শুরুতে ধস নামে চীনের স্মার্টফোন বাজারে। চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকে (জানুয়ারি-মার্চ) দেশটিতে স্মার্টফোন বিক্রি ৪০ শতাংশ কমার তথ্য মিলেছিল।
চলমান পরিস্থিতিতে শুরু থেকেই চীনের বাজারে স্মার্টফোন বিক্রি কমার ইঙ্গিত পাচ্ছিলেন বাজারসংশ্লিষ্টরা। তবে পরিস্থিতি এতটা খারাপের দিকে চলে যাবে, সেটা অনুধাবন করতে পারেননি অনেকে।
আইডিসির বিশ্লেষকদের দাবি, চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে চীনের ভোক্তাদের স্মার্টফোন ক্রয় কমছে। গত বছরের একই সময়ের তুলনায় চলতি বছরের শুরুতে স্মার্টফোন ক্রয় বাবদ ব্যয় ৩ কোটি ৩০ লাখ ডলার কমেছে।
শুধু চীনের অভ্যন্তরীণ বাজারের বিক্রি নয়, বৈশ্বিক স্মার্টফোন বাণিজ্যেও বড় ধস দেখা দিয়েছে। আইডিসির পূর্বাভাস অনুযায়ী, চলতি বছরজুড়ে বৈশ্বিক স্মার্টফোনের বাণিজ্য কমতে দেখা যাবে।
চীনের বাজারে স্মার্টফোন বিক্রিতে সবচেয়ে বড় ধস নামে গত ফেব্রুয়ারিতে। ওই সময় স্থবির হয়ে পড়ে পণ্যটির বাজার। নিজেদের ব্যবসা ধরে রাখতে রীতিমতো হিমশিম খেয়ে যায় স্মার্টফোন উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো। অন্যদিকে ভ্রমণসংক্রান্ত কড়াকড়ির কারণে চলাচল সীমিত হয়ে পড়ে কোটি কোটি চীনা নাগরিকের।
ওই সময় আইডিসির বিশ্লেষক সংগীতা শ্রীবাস্তব বলেন, যন্ত্রাংশের সংকট, কারখানা বন্ধ হয়ে পড়া, কোয়ারেন্টিন-সংক্রান্ত নিয়মকানুন, রসদ ঘাটতি ও চলাচলে সীমাবদ্ধতার কারণে সামনের দিনগুলোয়ও হ্যান্ডসেট প্রস্তুত এবং নতুন ডিভাইস বাজারে ছাড়তে গিয়ে বাধার সম্মুখীন হবেন স্মার্টফোন ভেন্ডররা।
চলতি বছর অনেক ব্র্যান্ডের ফাইভজি ফোন বাজারে এসেছে। ফাইভজি স্মার্টফোন ডিভাইস বিক্রয়ের ক্ষেত্রে ভারসাম্য ফেরাতে পারে বলে অভিমত দিয়েছেন সংগীতা শ্রীবাস্তব। তবে সেক্ষেত্রেও আগে সংক্রমণ পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসা প্রয়োজন বলে মনে করছেন তিনি।
কভিড-১৯ মহামারী পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে গত মার্চে অ্যাপলের পক্ষ থেকে বিনিয়োগকারীদের সতর্ক করে জানানো হয়, চীনের বাজারে স্মার্টফোন তৈরি ও বিক্রিতে সীমাবদ্ধতা আরোপের কারণে প্রতিষ্ঠানটির ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা আগে থেকেই ছিল। এ ক্ষতির মাত্রাকে আরো অনেক বাড়িয়ে দিয়েছে চলমান নভেল করোনাভাইরাস পরিস্থিতি।
বিনিয়োগকারীদের উদ্দেশে প্রকাশিত হালনাগাদ প্রতিবেদনে অ্যাপল জানায়, তারা চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকের রাজস্ব আয়সংক্রান্ত নির্দেশনায় যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল, তা পূরণ করা সম্ভব হবে না।
এ বিষয়ে প্রতিষ্ঠানটির বক্তব্য হলো দেশটির বিভিন্ন স্থানে বর্তমানে কার্যক্রম শুরু হয়ে গিয়েছে। কিন্তু শুরুতে যেভাবে ধারণা করা হয়েছিল, অ্যাপলের ব্যবসায়িক পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে আরো অনেক সময় লেগে যাবে।
কভিড-১৯ মহামারীর কারণে অ্যাপলের মতো বড় মাত্রায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আরেক বৃহৎ স্মার্টফোন প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান হুয়াওয়ে। চীনের বাজারে প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানটির স্মার্টফোনই বিক্রি হয় সবচেয়ে বেশি।