চীনের বাজারে বাংলাদেশী পণ্যের বিপুল সম্ভাবনা

বিপুল জনসংখ্যার কারণে রফতানির পাশাপাশি পণ্য আমদানিরও শীর্ষ দেশ চীন। গত বছর চীন ২ দশমিক ৪৮ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারের পণ্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি করেছে। এ বাজারে বাংলাদেশের অংশীদারিত্ব মাত্র দশমিক শূন্য ৫ শতাংশ। সম্প্রতি বাংলাদেশকে দেয়া শুল্কমুক্ত সুবিধার ব্যবহার এবং দেশটি থেকে অগ্রাধিকামূলক বাণিজ্য সুবিধা (এফটিএ) নিতে পারলে বাংলাদেশের জন্য চীনের বাজারে বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

চীনের আমদানি বাজারের কেবল ১ শতাংশ দখল করতে পারলেই বাংলাদেশ বছরে ২৫ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রফতানি করতে পারবে। দেশটিতে বর্তমানে ১০০ কোটি ডলারের কম মূল্যের পণ্য ও সেবা রফতানি করে বাংলাদেশ। গতকাল বুধবার ‘বাংলাদেশ-চায়না ইকোনমিক অ্যান্ড ট্রেড রিলেশনস ইন দি আফটারমাথ অব দ্য কভিড-১৯ গ্লোবাল প্যানডেমিক’ বিষয়ক ভার্চুয়াল আলোচনায় বিশেষজ্ঞরা এসব কথা বলেন। ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরাম (ইআরএফ) ও বাংলাদেশ-চায়না চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (বিসিসিসিআই) যৌথভাবে এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে।

অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে অনলাইনে যুক্ত ছিলেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি। ইআরএফ সাধারণ সম্পাদক এসএম রাশিদুল ইসলামের সঞ্চালনায় সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের (পিআরআই) গবেষণা পরিচালক ড. মোহাম্মদ আব্দুর রাজ্জাক। অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির বক্তব্য রাখেন ঢাকায় নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত লি জিমিং, বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) নির্বাহী চেয়ারম্যান মো. সিরাজুল ইসলাম, চীনে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মাহবুব উজ জামান প্রমুখ।

মূল প্রবন্ধে ড. আবদুর রাজ্জাক বলেন, বর্তমান বৈশ্বিক বাস্তবতা বলছে ২০২৮ সালে চীন পৃথিবীর সবচেয়ে বড় অর্থনীতির দেশ হবে। অন্যদিকে চীন এখনই বিশ্বের সবচেয়ে বড় রফতানিকারক দেশ। দেশটি বর্তমান বৈশ্বিক রফতানি বাণিজ্যের এক-তৃতীয়াংশ নিয়ন্ত্রণ করছে। রফতানির পাশাপাশি চীনের আমদানি বাজারও বেশ বড়। সর্বশেষ বছরে দেশটি ২ দশমিক ৬৯ ট্রিলিয়ন ডলার রফতানির বিপরীতে ২ দশমিক ৪৮ ট্রিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি করেছে। বিপুল ভোক্তা বাজারে বাংলাদেশের জন্য বড় সুযোগ রয়েছে।

তিনি বলেন, চীন বৈশ্বিক বাজার থেকে যে পরিমাণ পণ্য আমদানি করছে বাংলাদেশ এখন তার মাত্র দশমিক শূন্য ৫ শতাংশ সরবরাহ করছে। এটি যদি ১ শতাংশে উন্নীত করা যায় তবে চীনের বাজারে অতিরিক্ত ২ হাজার ৫০০ কোটি ডলারের পণ্য রফতানি সম্ভব। এক্ষেত্রে তৈরি পোশাকের সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি উল্লেখ করে ড. রাজ্জাক বলেন, তৈরি পোশাকের বাজারের জন্য চীন একটি বড় আমদানি কেন্দ্র হিসেবে রূপান্তরিত হচ্ছে। চীনের আরএমজি বাজারের বর্তমানে ৭ শতাংশ বাংলাদেশের দখলে। যেখানে ভিয়েতনামের দখলে ১৯ শতাংশের বেশি। এখানে একটু নজর দিলেই বিশাল বাজার খুঁজে পাবে বাংলাদেশ।

অনুষ্ঠানে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেন, চীন বাংলাদেশের বৃহত্তম বাণিজ্য অংশীদার। গত বছর বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যে মোট বাণিজ্য ছিল ১ হাজার ২০৯ কোটি ডলার। এর মধ্যে চীন থেকে বাংলাদেশের আমদানি ছিল ১ হাজার ১৪৯ কোটি ডলার এবং বাংলাদেশ থেকে চীনে রফতানি মাত্র ৬ কোটি ডলার। উভয় দেশের বর্তমান বাণিজ্য সম্পর্ক চীনের পক্ষে। ২০২০ সালে চীন আমাদের জন্য ৯৭ শতাংশ শুল্কমুক্ত সুবিধা দিয়েছে। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশও বাণিজ্যে সুবিধা করতে পারবে বলে আমি মনে করি।

তিনি বলেন, ২০১৬ সালে চীনের প্রধানমন্ত্রীর বাংলাদেশ সফর এবং ২০১৯ সালে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর চীনের সফর বাণিজ্য বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ। ওই সফরে উভয় দেশের মধ্যে বেশকিছু চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। উভয় সফরেই আমরা এফটিএ নিয়ে কথা বলেছি। এর কিছু অগ্রগতিও রয়েছে। তবে এটি দ্রুত বাস্তবায়নে আমাদের আরো প্রচেষ্টা চালাতে হবে। এলডিসি গ্র্যাজুয়েশনের আগেই এটি হবে এবং বাংলাদেশ এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন-পরবর্তী চ্যালেঞ্জ ভালোভাবে মোকাবেলা করবে বলে আমি আশাবাদী।

বাংলাদেশে চীনের বিপুল বিনিয়োগ রয়েছে জানিয়ে ওই দেশের বাজারে বাংলাদেশের জন্য নতুন সম্ভাবনা রয়েছে বলে মনে করছেন দেশটির নিযুক্ত বাংলাদেশের অ্যাম্বাসেডর লি জিমিং। তিনি বলেন, চীন ও বাংলাদেশের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ প্রতিবেশীর সম্পর্ক বহুদিনের। ৪৫ বছর ধরে দুই দেশের মধ্যে উচ্চপর্যায়ের লেনদেনে সুষম গতি বজায় রয়েছে। অর্থনীতি, বাণিজ্য ও বিনিয়োগ খাতে সহায়তা ক্রমে গভীর হচ্ছে। গত বছরের জুলাইয়ে বাংলাদেশকে ৯৭ শতাংশ পর্যন্ত শুল্কমুক্ত সুবিধা দিয়েছে চীন। ফলে চীনের বাজারে বাংলাদেশের বাণিজ্যের জন্য নতুন সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। গত বছর বাংলাদেশ থেকে চীনের পণ্য আমদানি ২৮ শতাংশ বেড়েছে। ভবিষ্যতে বাংলাদেশ থেকে চীনের আমদানি আরো বাড়বে। দুই দেশের বাণিজ্যে ব্যালান্সড তৈরি হবে। তিনি বলেন, উভয় দেশের বাণিজ্য বাড়াতে বিদ্যমান শুল্কমুক্ত সুবিধা ছাড়াও এফটিএ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারবে। তবে এক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকারকে আরো বেশি কাজ করতে হবে।

অনুষ্ঠানে বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে আমাদের অবকাঠামো, টেলিযোগাযোগ, বিদ্যুৎ-জ্বালানিসহ প্রায় সব খাতেই চীনের বিনিয়োগ এসেছে। পদ্মা সেতুর রেল লিংক এর মধ্যে অন্যতম। তবে চীনের এখনো বাংলাদেশে বিপুল বিনিয়োগের সুযোগ রয়েছে। দুই প্রধানমন্ত্রীর উভয় দেশ সফরে আলোচনা অনুযায়ী বাংলাদেশে ২ হাজার ৭০০ কোটি ডলার বিনিয়োগ করার কথা রয়েছে। এখন পর্যন্ত আমরা ২০০ কোটি ডলার বিনিয়োগ পেয়েছি। এ খাতে তাদের সঙ্গে আলোচনা করে বিনিয়োগ বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে।

0Shares

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *