কৃষকের কাছ থেকে ধান পাওয়াই কঠিন, সরকারের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ নিয়ে এবারও শঙ্কা

সরকারি দরের চেয়ে খোলা বাজারে দাম বেশি ছিল, তাই গত দুই মৌসুমে সরকারি গুদামে ধান বিক্রি করেননি কৃষক। চলতি বোরো মৌসুমে দাম কেজিপ্রতি এক টাকা বাড়িয়ে সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। তবে ধান কেনার প্রক্রিয়ায় ত্রুটি থাকায় কৃষকরা সরকারি গুদামে এবারও ধান দেবেন কিনা, তা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। এ জন্য এবারও সরাসরি কৃষকের কাছে ধান কেনা সরকারের জন্য কঠিন হবে।

সরকার এবার সাড়ে ছয় লাখ টন ধান কিনতে চায়। গত বছরের চেয়ে সাড়ে তিন লাখ টন কম। এরপরও লক্ষ্যমাত্রা পূরণ নিয়ে শঙ্কা রয়েছে। কারণ, যথাসময়ে ধান কেনা শুরু করেনি সরকার। যেমন গতকাল বুধবার পর্যন্ত হাওর অঞ্চলে ৭০ থেকে ৭১ ভাগ ধান কাটা শেষ হওয়ার পর ক্রয় কার্যক্রম উদ্বোধন করেছেন খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার। বহু কৃষক আগেই ফড়িয়াদের কাছে ধান বিক্রি করেছেন।

এ ছাড়া ধানের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে সারাদেশে ২০০টি স্টিলের মিনি পেডি সাইলো (ধান সংরক্ষণের বিশেষ ব্যবস্থা) দু’বছর আগে নির্মাণের উদ্যোগ নেয় সরকার। কিন্তু এখনও তা নির্মাণের কাজ শুরু হয়নি। পাশাপাশি ধানের ময়েশ্চার (আর্দ্রতা) মাপার যন্ত্র নেই। যন্ত্রটি না থাকায় কৃষককে সরকারি গুদাম থেকে ফিরে আসতে হবে। দেশের আবহাওয়াগত কারণেই গ্রামে অবাণিজ্যিক চাতালে ধান শুকালে তা সরকারি চাহিদা মতো ১৩ শতাংশ আর্দ্রতা পর্যন্ত শুকানো যায় না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সর্বনিম্ন ১৬-১৭ শতাংশ পর্যন্ত আর্দ্রতা থাকে। ফলে বেশিরভাগ কৃষক সরকারের কাছে ধান বিক্রি করতে পারবেন না। খাদ্য অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক বদরুল হাসান বলেন, কৃষকের কাছে ন্যায্যমূল্যে ধান কিনতে হলে পেডি সাইলো নির্মাণের যে উদ্যোগ, সেটি দ্রুত শেষ করতে হবে। প্রয়োজনে কৃষি বিভাগ থেকে আর্দ্রতা মাপার যন্ত্র সরবরাহ করতে হবে। তাহলে সরকারি গুদামে ধান বিক্রি করতে কৃষকের ভোগান্তি কমবে। ২০১৯ সাল থেকে সরকার সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে
সারাদিন এসিতে থাকার পরও ত্বকে সমস্যা, জানুন সমাধান ≣ করোনা আক্রান্ত ঐন্দ্রিলা, সঙ্গ দিচ্ছেন অঙ্কুশ ≣ এবার শিশুদের টিকার ট্রায়াল শুরু করল ফাইজার

ধান কেনা শুরু করেছে। কিন্তু এখনও ধান সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়নি। ফলে কৃষকদের কাছ থেকে বেশি পরিমাণ ধান কিনতে পারছে না সরকার। সংশ্নিষ্টরা জানান, মজুদ করার মতো পর্যাপ্ত জায়গা না থাকায় চাল তৈরির জন্য ধান আবার মিলারদের কাছে পাঠানো হয়। এতে পরিবহন খরচসহ বিভিন্নভাবে চালের দাম বেড়ে যায়। এসব কারণে ধান কেনার লক্ষ্যমাত্রা কমিয়েছে সরকার।

খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার বলেন, ন্যায্যমূল্যে কৃষকের কাছে ধান কেনার জন্য এবার কড়া নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। গুদামে ধান দেওয়ার সময় কৃষককে যাতে কোনো প্রকার হয়রানির শিকার হতে না হয়, এ জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

খাদ্যমন্ত্রী বলেন, পাঁচ হাজার টন ধারণ ক্ষমতার ২০০টি পেডি সাইলো করার সিদ্ধান্ত ছিল। এর ধারণ ক্ষমতা পাঁচ হাজারের স্থলে ১০ হাজার টন করার জন্য বলা হয়েছে। এ-সংক্রান্ত ডিপিপি তৈরি করে পরিকল্পনা কমিশনে দিয়েছি। বিদেশি অনুদানের মাধ্যমে আরও ১৭০টি সাইলো করার সিদ্ধান্ত আছে। এটা প্রক্রিয়াধীন। তবে করোনাভাইরাসের কারণে এসব কাজ পিছিয়ে গেছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক খাদ্য বিভাগের একাধিক কর্মকর্তা বলেন, ধান শুকানোর মাত্রা নিয়ে সমস্যা এবার নতুন নয়, আরও আগে থেকেই এই সমস্যা চলে আসছে। এ কারণে সরাসরি কৃষকের কাছে ধান কেনা নিয়ে জটিলতা তৈরি হয়। খাদ্য বিভাগের একটি চক্র ডিলারদের যোগসাজশে এই সমস্যা টিকিয়ে রাখতে নানাভাবে কারসাজি করে। ঢাকা বিভাগে এবার ৪৬ লাখ ৫৭ হাজার ৪৪৩ টন বোরো ধান উৎপাদন হয়েছে। সরকার এক লাখ এক হাজার ১৮৩ টন কিনবে। ময়মনসিংহ বিভাগে উৎপাদন হয়েছে ৪৩ লাখ ১১ হাজার ৪১৮ টন ধান। সরকার কিনবে মাত্র ৫৩ হাজার ৬৬৪ টন ধান। হাওর অঞ্চলের সুনামগঞ্জ জেলায় এবার তিন লাখ ২৩ হাজার ৩৩০ হেক্টর জমিতে ধানের চাষাবাদ হয়েছে। এতে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১৪ লাখ ৬০ হাজার টন। কিন্তু সরকার নামমাত্র ধান কিনবে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা অঞ্চলের আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রক তপন কুমার দাস বলেন, সারাদেশে যে পরিমাণ ধান উৎপাদন হয়, সে হিসেবে ধান কেনা হয় না। কারণ, উৎপাদন অনুযায়ী ধান কিনলে সরকারের সংরক্ষণের জায়গা থাকবে না।

তিনি বলেন, সরকার তার প্রয়োজন অনুযায়ী ধান-চাল সংগ্রহ করে। গত দুই মৌসুমে সরকারি গুদামের চেয়ে খোলা বাজারের ধানের দাম বেশি ছিল। ফলে লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করা সম্ভব হয়নি। আশা করি, এবার সম্ভব হবে। এ জন্য প্রতি কেজি ধানে এক টাকা করে দাম বাড়ানো হয়েছে।

হাওর অঞ্চলের মধ্যনগরের আড়তদার সমিতির সভাপতি জহিরুল ইসলাম বলেন, এবারও কৃষক সরকারের কাছে ধান বিক্রি করতে পারবেন না। কারণ, আড়তে প্রতিদিন ১৫ থেকে ২০ হাজার মণ ধান কেনা হচ্ছে। সরকারি গুদামে ময়েশ্চার সমস্যা, ধান দিলে টাকা পাই তিন দিন পর, এসব হয়রানির জন্য সরকারি ক্রয় কেন্দ্রে যেতে চান না কৃষক। বৈশাখের প্রথম দিকে হাওর অঞ্চলের ক্রয় কেন্দ্রে ধান কেনা শুরু হলে কৃষকের উপকার হতো, সরকারও ধান কিনতে পারত।

হাওরের কৃষি ও কৃষক রক্ষা সংগ্রাম পরিষদের সাধারণ সম্পাদক চিত্ত রঞ্জন তালুকদার বলেন, সারাদেশে এক সঙ্গে ধান-চাল কেনার চিন্তা থেকে বের হয়ে আসতে হবে সরকারকে। হাওরাঞ্চলে ধান আগে কাটা শুরু হয়, তাই আগে কিনতে হবে।

রাজনগর উপজেলার কাউয়াদীঘি হাওরপাড়ের কেওলা গ্রামের কৃষক সিরাজুল ইসলাম ছানা বলেন, শুনেছি সরকার নাকি এক হাজার ৮০ টাকা দরে ধান কিনবে। কিন্তু এখনও ধান কেনা শুরু হয়নি। অথচ বেশিরভাগ ধান কাটা শেষ হয়ে গেছে। টাকার প্রয়োজনে কম দামে লোকসানে ফড়িয়া ও দালালদের কাছে ধান বিক্রি করে দিয়েছি। কারণ, ধান কাটাকালীন খরচ মেটাতে টাকার খুব দরকার ছিল।

0Shares

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *