ইন্দোনেশিয়ার কয়লা রফতানিতে নিষেধাজ্ঞায় পায়রা ও রামপাল নিয়ে দুশ্চিন্তা

থানীয় বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোয় সরবরাহ ঠিক রাখতে কয়লা রফতানির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে ইন্দোনেশিয়া। দেশটির জ্বালানি মন্ত্রণালয় থেকে গতকালই এ বিষয়ে এক বিজ্ঞপ্তি জারি করা হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে দেশের জ্বালানি খাতে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। দেশে কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ প্রকল্পগুলোর বেশির ভাগেরই জ্বালানি পরিকল্পনা সাজানো হয়েছিল ইন্দোনেশিয়া থেকে কয়লা আমদানিতে গুরুত্ব দিয়ে। যদিও বিদ্যুৎ বিভাগ বলছে, ইন্দোনেশিয়ার দুয়ার বন্ধ হয়ে গেলে প্রয়োজনে বিকল্প বাজার থেকে কয়লা আমদানি করা হবে।

এ মুহূর্তে বড় এক অস্থিতিশীল সময় পার করছে বৈশ্বিক জ্বালানি বাজার। বিশেষ করে এলএনজিসহ প্রাকৃতিক গ্যাসভিত্তিক পণ্যগুলোর মূল্য পরিস্থিতি আমদানিকারক দেশগুলোকে বিপদে ফেলে দিয়েছে। বিপাকে পড়েছে দেশের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতও। জাতীয় গ্রিডে প্রয়োজনীয় মাত্রায় বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে পারছে না গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো। সারা দেশে বর্তমানে গ্যাস সংকটে দুই হাজার মেগাওয়াট সক্ষমতার বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ রয়েছে। টেকসই উৎস নিশ্চিত না করে শুধু এলএনজি আমদানির মাধ্যমে এ সংকট মোকাবেলা নিয়েও রয়েছে অনিশ্চয়তা। এ অবস্থায় নির্ভরতা বেড়েছে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর ওপর।

গত এক দশকে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুতের বেশ কয়েকটি মেগা প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। প্রকল্পগুলোর মধ্যে পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্র এরই মধ্যে উৎপাদনে এসেছে। মূলত ইন্দোনেশিয়া থেকে আমদানীকৃত কয়লার ওপর নির্ভর করেই চলছে বিদ্যুৎকেন্দ্রটির কার্যক্রম। আগামী মার্চে উৎপাদনে যাওয়ার কথা রয়েছে রামপাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের। এ বিদ্যুৎকেন্দ্রেরও উৎপাদন কার্যক্রম ইন্দোনেশিয়া থেকে সরবরাহকৃত কয়লার মাধ্যমেই চালানোর কথা রয়েছে। প্রকল্পের সংশোধিত তথ্য অনুযায়ী, গত মাসেই বিদ্যুৎকেন্দ্রটির একটি ইউনিট চালু হওয়ার কথা ছিল। তবে কভিডের কারণে তা কিছুটা পিছিয়ে পড়ে। বর্তমান প্রেক্ষাপট বিবেচনায় প্রকল্পটির কার্যক্রম আর বিলম্বিত করতে চাইছে না বিদ্যুৎ বিভাগ। যদিও ইন্দোনেশিয়ার সর্বশেষ সিদ্ধান্ত রামপালে সময়মতো বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু করা নিয়ে বড় ধরনের সংশয় তৈরি করেছে।

মূলত বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের ডমেস্টিক মার্কেট অবলিগেশন (ডিএমও) নীতিমালা প্রয়োগ করতে গিয়ে এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে জাকার্তা। এ নীতিমালা অনুযায়ী দেশটির কয়লা উত্তোলন শিল্পের প্রতিষ্ঠানগুলোর মোট বার্ষিক উত্তোলনের কমপক্ষে ২৫ শতাংশ রাষ্ট্রায়ত্ত পেরুসাহান লিসট্রিক নেগারাকে (পিএলএন) সরবরাহ করতে হয়। এক্ষেত্রে উত্তোলক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ইন্দোনেশিয়া সরকারের পক্ষ থেকে মূল্য পরিশোধ করা হয় টনপ্রতি সর্বোচ্চ ৭০ ডলার করে। তবে প্রচলিত বাজারদরের চেয়ে অনেক কম হওয়ায় দেশটির উত্তোলক প্রতিষ্ঠানগুলো সরকারকে পণ্য সরবরাহে খুব একটা উৎসাহী নয়। গত বছরও দেশটির কয়লা উত্তোলনকারীরা নির্ধারিত মাত্রায় জ্বালানি পণ্যটি সরবরাহ করতে পারেনি। বর্তমানে দেশটির বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোয় ব্যবহারের জন্য সরকারি মজুদেও বড় ধরনের ঘাটতি তৈরি হয়েছে।

এ বিষয়ে দেশটির জ্বালানি মন্ত্রণালয়ে খনিজ ও কয়লা বিভাগের মহাপরিচালক রিদওয়ান জামালুদ্দিন স্বাক্ষরিত এক বিবৃতিতে বলা হয়, প্রশ্ন উঠতে পারে, কী কারণে আমরা সবার ওপর রফতানি নিষেধাজ্ঞা আরোপ করছি। কিন্তু এ বিষয়ে আমাদের আর কোনো কিছু করার ছিল না এবং এটি সাময়িক। যদি এ নিষেধাজ্ঞা বাস্তবায়ন করা না হয়, তাহলে আমাদের ১০ হাজার ৮৫০ মেগাওয়াটক্ষমতার ২০টির মতো বিদ্যুৎকেন্দ্রকে বসিয়ে রাখতে হবে। যদি এখনই কৌশলগত কোনো পদক্ষেপ নেয়া না হয়, তাহলে পরিস্থিতি ব্যাপক মাত্রায় ব্ল্যাকআউটের দিকেও চলে যেতে পারে।

তিনি জানান, গত বছর পাওয়ার প্লান্টগুলোয় কয়লা উত্তোলনকারীরা পণ্য সরবরাহ করেছে ডিএমওতে নির্ধারিত মাত্রার চেয়ে অনেক কম। এ কারণে বছর শেষ হওয়ার আগেই কয়লার মজুদ সংকট দেখা দেয়। ৫ জানুয়ারি এ নিষেধাজ্ঞার সিদ্ধান্ত পর্যালোচনা করে দেখবে ইন্দোনেশিয়া সরকার।

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশ ইন্দোনেশিয়া বিশ্বের বৃহত্তম কয়লা রফতানিকারক দেশ। ২০২০ সালে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রায় ৪০ কোটি টন কয়লা রফতানি করেছে দেশটি। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় শুধু জানুয়ারিতেই গড়ে তিন কোটি টনের মতো কয়লা রফতানি করে দেশটি। বিদ্যুৎ ও শিল্পোৎপাদন খাতে ব্যবহারের জন্য ইন্দোনেশিয়া থেকে শীর্ষ আমদানিকারক দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে চীন, ভারত, জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়া।

বাংলাদেশে বিদ্যুৎ খাত ইন্দোনেশিয়া থেকে আমদানীকৃত কয়লার ওপর অনেকটাই নির্ভরশীল হলেও দেশটির নতুন এ সিদ্ধান্ত নিয়ে এ মুহূর্তে খুব একটা দুশ্চিন্তার কিছু নেই বলে মনে করছেন বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতসংশ্লিষ্টরা।

এ বিষয়ে বিদ্যুৎ বিভাগের সচিব মো. হাবিবুর রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, ইন্দোনেশিয়া কয়লা রফতানি বন্ধ করলেও সেটি সাময়িক সময়ের জন্য। তার পরও আমরা বিভিন্ন দেশের কয়লা আমদানি নিয়ে কথা বলে রেখেছি। যদি কয়লা আমদানির এ উৎস বন্ধ হয়ে যায় তাহলে বিকল্প হিসেবে দক্ষিণ আফ্রিকা ও অস্ট্রেলিয়া আমাদের জন্য খোলা রয়েছে।

তবে বিকল্প বাজার থেকে আমদানি করা হলেও কয়লার গুণগত মান নিয়ে সংশয় থেকে যাচ্ছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। বিশ্বব্যাপী ইন্দোনেশিয়ার সরবরাহকৃত কয়লা মানের দিক থেকে সর্বোত্কৃষ্ট হিসেবে সমাদৃত। এছাড়া বৈশ্বিক জ্বালানি পণ্যের বাজার এরই মধ্যে বেশ অস্থিতিশীল একটি সময় পার করছে। ইন্দোনেশিয়ার নতুন সিদ্ধান্ত এ অস্থিতিশীলতাকে আরো বাড়িয়ে দেয়ার বড় আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।

জাকার্তাভিত্তিক আর্থিক সেবা খাতের প্রতিষ্ঠান ব্যাংক মানডিরির জ্বালানি শিল্প বিশ্লেষক আহমাদ জুহদি দিউয়ি কুসুমার বরাত দিয়ে বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানিয়েছে, ইন্দোনেশিয়ার নতুন এ সিদ্ধান্ত কয়লার গোটা বিশ্ববাজারকেই ঊর্ধ্বমুখী করে তুলতে পারে। তিনি বলেন, এ নিষেধাজ্ঞার কারণে সামনের দিনগুলোয় বিশ্বব্যাপী কয়লার দাম বাড়তির দিকে চলে যাবে। এরই মধ্যে বিশ্বব্যাপী কয়লার মজুদ এখন কমতির দিকে। এছাড়া ইন্দোনেশিয়ার ক্রেতারা বর্তমান পরিস্থিতিতে রাশিয়া, অস্ট্রেলিয়া ও মঙ্গোলিয়ার মতো দেশগুলোর দিকে ঝুঁকে পড়বে। বিশ্বব্যাপী পণ্যটি নিয়ে অনিশ্চয়তার মুহূর্তে বাজারের সবাই সাধারণত সবচেয়ে নিরাপদ অংশীদারকেই খুঁজতে থাকে।

পণ্যটির বাজারদর নিয়ে অনিশ্চয়তা বাড়াচ্ছে চীনের বর্ধিত চাহিদা। গত বছরের নভেম্বরে দেশটির আমদানি গত বছরের সর্বোচ্চে পৌঁছে। শীতকালীন জ্বালানির বাড়তি চাহিদা মেটাতে দেশটিতে এখন জ্বালানি পণ্যটির মজুদ বাড়িয়ে তোলা হচ্ছে। এছাড়া স্থানীয় সরবরাহকারীদেরও উত্তোলন বাড়ানোর আদেশ দিয়েছে বেইজিং।

এর আগে গত বছরের আগস্টেও ইন্দোনেশিয়ার এমন এক সিদ্ধান্তে কয়লার বিশ্ববাজারে মূল্য অস্থিতিশীল হয়ে উঠেছিল। ওই সময় স্থানীয় ৩৪ সরবরাহকারীর ওপর রফতানি নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল ইন্দোনেশিয়া। সে সময়ও গত বছরের প্রথম ছয় মাসে ডিএমও অনুযায়ী নির্ধারিত মাত্রায় সরবরাহ করতে না পারায় এ নিষেধাজ্ঞা আরোপের কথা জানিয়েছিল জাকার্তা।

দেশের বিদ্যুৎ খাতের নীতিগবেষণায় সংশ্লিষ্টরাও মনে করছেন, ইন্দোনেশিয়ার এ সিদ্ধান্ত দেশে কয়লা আমদানিতে ব্যয় বাড়াতে যাচ্ছে। পাওয়ার সেলের ডিজি প্রকৌশলী মোহাম্মদ হোসাইন এ বিষয়ে বণিক বার্তাকে বলেন, ইন্দোনেশিয়া কয়লা রফতানি বন্ধ করে দিলে আমাদের সাপ্লাই চেইনে বড় ধরনের পরিবর্তন আসবে। যদিও বিকল্প দেশ হিসেবে দক্ষিণ আফ্রিকা ও অস্ট্রেলিয়ার দুয়ার আমাদের জন্য খোলা রয়েছে। তবে দূরত্ব ও কয়লার গুণগত মান বিবেচনায় এক ধরনের সংকট তৈরি হবে। একই সঙ্গে কয়লার আমদানি খরচও বেড়ে যাবে।

0Shares

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *