ইটিপি সচল রাখতে চালু হচ্ছে অনলাইন নজরদারি

নদী ও খালের পানি দূষণে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখে শিল্পকারখানার অপরিশোধিত তরলবর্জ্য। শিল্প-কারখানায় ব্যবহূত তরলবর্জ্য পরিশোধন করার জন্য শোধনাগার বা ইটিপি প্লান্ট স্থাপনের আইন থাকলেও অনেক শিল্পপ্রতিষ্ঠানই ইটিপি প্লান্ট স্থাপন না করেই কারখানা চালাচ্ছে বছরের পর বছর। আইনের ভয়ে কিংবা জরিমানা থেকে বাঁচতে ইটিপি প্লান্ট স্থাপন করলেও বছরে একদিনও ইটিপি মেশিন চালু করে না এমন প্রতিষ্ঠানের সংখ্যাও কম নয়। এ অবস্থায় কারখানা মালিকদের কারচুপি রুখতে কারখানার ইটিপি প্লান্ট বা শোধনাগার চালু রাখার বিষয়টি অনলাইনে নজরদারির পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে পরিবেশ অধিদপ্তর।

পরীক্ষামূলকভাবে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অধীনে একসেস টু ইনফরমেশন (এটুআই) এবং জার্মান-বাংলাদেশ উন্নয়ন সংস্থা (জিআইজেড) এ দুই প্রতিষ্ঠান নির্দিষ্টসংখ্যক কিছু শিল্প-কারখানা অনলাইন নজরদারির আওতায় আনবে। ক্রমান্বয়ে ঢাকাসহ দেশের বড় বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠানের ইটিপি সিস্টেমও অনলাইন নজরদারি করবে পরিবেশ অধিদপ্তর।

ইটিপি প্লান্টের ব্যয় অনেক। মূলত এজন্যই কারখানা মালিকদের ইটিপি ব্যবহারে ঘোর অনীহা। অন্যদিকে আইনের চোখ এড়াতে অনেক কারখানা মালিকই দিনের নির্ধারিত সময়ে ইটিপি সচল রাখেন। রাতে কিংবা যখন পরিবেশ অধিদপ্তরের এনফোর্সমেন্ট বিভাগের অভিযানের সম্ভাবনা কম ওই সময় ইটিপি মেশিন বন্ধ রেখেই তরলবর্জ্য সরাসরি নদীতে ফেলা হয়। আর এভাবেই দূষিত হচ্ছে রাজধানীর প্রধান চার নদীসহ দেশের উল্লেখযোগ্য নদ-নদী।

ইটিপি প্লান্ট ব্যবহারে আরেক ধরনের কারচুপির কথাও উঠে এসেছে বণিক বার্তার অনুসন্ধানে। সেটি হলো গাজীপুরের অনেক কারখানাই অপরিশোধিত তরলবর্জ্য মাটির নিচে চাপা দিচ্ছে। এতে করে জীববৈচিত্র্য ও প্রতিবেশগত হুমকির মুখে পড়ছে বলে সতর্ক করেছেন পরিবেশবিদরা।

পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, লোকবল কম থাকার কারণে এবং শিল্পপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা আগের চেয়ে অনেক বেড়ে যাওয়ায় সঠিকভাবে মনিটরিং করা সম্ভব হচ্ছে না। তাছাড়া কোনো ফ্যাক্টরিতেই সার্বক্ষণিক মনিটরিং করা সত্যিকার অর্থেই সম্ভব নয়।

অনলাইন নজরদারির ফলে ইটিপি ব্যবহারে ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে উল্লেখ করে পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, অভিযানে গিয়ে এক একটি কারখানাকে ৫ লাখ থেকে ১০ লাখ টাকা জরিমানা করা হচ্ছে। অনেক শিল্প-কারখানা জরিমানা দিতে প্রস্তুত, কিন্তু ইটিপি মেশিন চালাতে চায় না। কারণ ইটিপি মেশিনের খরচের চেয়ে জরিমানার অর্থের পরিমাণ অনেক কম থাকে। আইনগত কারণেই নির্দিষ্ট পরিমাণের বেশিও জরিমানা করা যায় না ওইসব প্রতিষ্ঠানকে।

পরিবেশ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক মো. হুমায়ুন কবীর এ বিষয়ে বণিক বার্তাকে বলেন, অনলাইন নজরদারি শুরু করতে পারলে একসঙ্গে সব শিল্প-কারখানা আমাদের নখদর্পণে চলে আসবে। এখানে বসেই আমি বুঝতে পারব কোন প্রতিষ্ঠান কখন ইটিপি প্লান্ট সচল করেছে কিংবা কখন শোধন না করেই তরলবর্জ্য অপারেশন করেছে। তখন আমরা সহজেই অনিয়ম করা কারখানার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারব।

ইটিপি প্লান্টের অনলাইন নজরদারির বিষয়টিকে ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখছেন নগরবিদ ইকবাল হাবিব। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, পরিবেশ অধিদপ্তরের এ উদ্যোগ সফল হলে কল-কারখানার তরলবর্জ্যে নদী-খাল দূষণ অনেক কমবে। তবে এক্ষেত্রে পরিবেশ অধিদপ্তরকে সচেতন থাকতে হবে কারখানা মালিকরা যেন কোনো চোরাপথ খুলে না বসে। দেখা গেল তারা ইটিপি প্লান্ট সচল করল আবার তরলবর্জ্যের একাংশ মাটি চাপা দিল—তখন পরিবেশ আরো মারাত্মকভাবে দূষণ হবে। তিনি আরো বলেন, সিসি ক্যামেরাসহ যে ধরনের মেশিন কারখানায় বসানো হবে, এসব মেশিনের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব যেন কারখানা মালিকদের হাতে দেয়া হয়। এতে করে মেশিন নষ্টের অজুহাত দেখিয়ে নজরদারির বাইরে থাকার সুযোগ কারখানা মালিকরা পাবেন না।

পরিবেশ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, ইটিপির অনলাইন নজরদারির ক্ষেত্রে দুটি বিষয় নিশ্চিত করা হবে। কারখানাগুলো ইটিপি প্লান্ট ঠিকমতো সচল করছে কিনা এবং কতটুকু পানি ব্যবহার করছে আবার ওই পরিমাণ তরলবর্জ্য শোধন করছে কিনা তা-ও পরিমাপ করা হবে। পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক (পরিবেশগত ছাড়পত্র) মাসুদ ইকবাল মো. শামীম বণিক বার্তাকে বলেন, বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো ইটিপি প্লান্ট অনলাইন নজরদারির কথা ভাবা হচ্ছে। পুরো বিষয়টি কেমন হবে, কী কী প্রযুক্তি বসানো হবে, কতটুকু ডাটা প্রয়োজন, খরচ কেমন হবে, এ বিষয়গুলো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হচ্ছে। এখন অল্প কিছু কারখানা অনলাইন নজরদারির আওতায় আনা হবে। পরবর্তী সময়ে বিশ্বব্যাংকের একটি প্রজেক্টের মাধ্যমে রাজধানীর সব শিল্প-কারখানার ইটিপি প্লান্ট অনলাইনের মাধ্যমে নজরদারির পরিকল্পনা করছি আমরা।

তবে অনলাইন নজরদারির ফলে যেন ভোগান্তি বা সমস্যা কোনোটাই না বাড়ে এ বিষয়টি নিশ্চিত করার পরামর্শ দিয়েছেন বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সহসভাপতি ফজলুল হক। তিনি বলেন, যেহেতু এটি সম্পূর্ণ নতুন একটি পদ্ধতি সেক্ষেত্রে দক্ষতার সঙ্গে পরিচালনা করা না গেলে ফ্যাক্টরি মালিকদের ভোগান্তি বাড়তে পারে। দেখা গেল একজনের জরিমানা আরেকজনের নামে চলে এসেছে। একজনের ইটিপির হিসাব আরেকজনের সার্ভারে শো করল ইত্যাদি। এগুলো কম্পিউটারের ভুলের কারণে নয়, দক্ষ অপারেটরের অভাবে ঘটতে পারে। তাই আগে থেকেই সতর্ক হয়ে এগোতে হবে।

বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, শুধু ইটিপি মেশিন সচল এবং পানির পরিমাণ নজরদারি করলেই হবে না, পাশাপাশি ইটিপির বিদ্যুৎ মিটার এবং কারখানার বিদ্যুৎ মিটার আলাদা করতে হবে এবং নজরদারির আওতায় আনতে হবে। এতে করে তরলবর্জ্য শোধনের বিষয়টি সঠিকভাবে নজরদারি করা যাবে। নয়তো দেখা যাবে, ইটিপি প্লান্ট সচল রাখা হয়েছে কিন্তু তাতে সঠিক পরিমাণের কেমিক্যাল দেয়া হয়নি। ফলে ময়লা পানিই নদীতে পড়বে।

0Shares

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *