অস্থায়ী গেটকিপারদের বেতনেই সিংহভাগ ব্যয়!

রেলের সারা দেশে বিদ্যমান লেভেল ক্রসিংয়ের মধ্যে প্রায় অর্ধেকই অবৈধ। গত এক দশকে রেলের উন্নয়নে বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ হলেও ক্রসিংয়ের উন্নয়নে বিনিয়োগ যৎসামান্য। গেটম্যান নিয়োগ প্রক্রিয়া দীর্ঘদিন বন্ধ থাকায় অস্থায়ী গেটম্যান নিয়োগ ও নাজুক ক্রসিংগুলো সংস্কারে ছয় বছর আগে দুটি প্রকল্প হাতে নেয়া হয়। কিন্তু প্রকল্পের সিংহভাগ অর্থই অস্থায়ী গেটম্যানের বেতন-ভাতার পেছনে ব্যয় হওয়ায় ক্রসিং সংস্কারকাজও ঠিকমতো হয়নি, যার কারণে প্রতিনিয়ত বাড়ছে লেভেল ক্রসিং দুর্ঘটনা।

২০১৫ সালে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চল ও পশ্চিমাঞ্চলের লেভেল ক্রসিংগুলোর পুনর্বাসন ও মানোন্নয়ন শীর্ষক দুটি প্রকল্প হাতে নেয়া হয়। প্রকল্পের অধীনে পূর্বাঞ্চলে ৩২৮টি লেভেল ক্রসিংয়ের মানোন্নয়ন ও ১ হাজার ৩৮ জন গেটকিপার দেয়ার কথা ছিল। কিন্তু ৮১৭ জন নিয়োগ হলেও নিয়োগপ্রাপ্তদের একটি বড় অংশই চাকরি ছেড়ে দেন। মূলত ২০১৯ সালের জুনে প্রকল্পের মূল মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ায় বেতন-ভাতা অনিয়মিত হয়ে পড়লে গেটের জন্য নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মীদের অনেকেই চাকরি ছেড়ে দেন। এ প্রকল্পের শুরুতে বরাদ্দ ছিল ৪৯ কোটি ৩৩ লাখ টাকা। বর্তমানে প্রকল্পের মেয়াদ ২০২২ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। দ্বিতীয় সংশোধিত এ প্রকল্পের আকার বেড়ে ১০০ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। যদিও প্রকল্পের দুই-তৃতীয়াংশ টাকাই ব্যয় হচ্ছে অস্থায়ী গেটম্যানদের বেতন-ভাতা পরিশোধে।

অন্যদিকে পশ্চিমাঞ্চলে একই শিরোনামে নেয়া প্রকল্পটির জন্য শুরুতে বরাদ্দ ছিল ৪৭ কোটি ৮৪ লাখ টাকা। প্রকল্পের অধীনে ৩২৬টি ক্রসিংয়ের মানোন্নয়ন ছাড়াও ৮৫১ জন অস্থায়ী গেটম্যান নিয়োগ দেয়ার কথা ছিল। তবে ওই সময় নিয়োগ দেয়া হয় ৭৬৮ জন। নিয়োগপ্রাপ্তদের মধ্যে ১৩৯ জন চাকরি ছেড়ে চলে গেলেও বর্তমানে প্রকল্পের মেয়াদ বৃদ্ধির পর অস্থায়ীভাবে আরো বেশকিছু গেটম্যান নিয়োগ দেয়া হয়েছে। ২০২২ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত বর্ধিত প্রকল্পটির প্রথম সংশোধিত ব্যয় ধরা হয়েছে ৯২ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৬২ কোটি টাকাই অস্থায়ী গেটম্যানদের বেতন।

জানতে চাইলে পশ্চিমাঞ্চলের লেভেল ক্রসিংগুলোর পুনর্বাসন ও মানোন্নয়ন শীর্ষক প্রকল্পের পরিচালক বীরবল মণ্ডল বণিক বার্তাকে বলেন, লেভেল ক্রসিংয়ের জন্য নেয়া প্রকল্পে দুই-তৃতীয়াংশই ব্যয় হচ্ছে অস্থায়ী গেটম্যানদের বেতন-ভাতা প্রদানে। ২০১৯ সালের জুনে ক্রসিংয়ের মানোন্নয়ন প্রকল্পের কাজ শেষ হলেও অস্থায়ী গেটম্যানদের বেতন প্রদানে প্রকল্পের মেয়াদ ২০২২ সাল পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। রেলওয়ে বর্তমানে অস্থায়ী গেটম্যানদের পদগুলো রাজস্ব খাতে নিয়ে যেতে কাজ করছে। এটি বাস্তবায়ন হলে রেলওয়ের ক্রসিংগুলো অনেকটা সুরক্ষিত করা সম্ভব হবে। 

সারা দেশে রেলের ২ হাজার ৫৬১টি লেভেল ক্রসিং রয়েছে। এর মধ্যে ১ হাজার ১৪৯টি বা ৪৪ দশমিক ৮৭ শতাংশই অবৈধ। এছাড়া সারা দেশের বিভিন্ন প্রান্তে রেলের অবৈধভাবে তৈরি কয়েকশ লেভেল ক্রসিং রয়েছে। যদিও রেলের নথিতে এসব লেভেল ক্রসিংয়ের তথ্য উঠে আসেনি। মূলত রেলের অবৈধ লেভেল ক্রসিং ও লোকবলহীন বৈধ ক্রসিংগুলোতেই দুর্ঘটনা সবচেয়ে বেশি ঘটে। এছাড়া লেভেল ক্রসিংগুলো জরাজীর্ণ অবস্থায় থাকায় ট্রেন আসার সময় সিগন্যাল অমান্য করে যানবাহন চলাচলকালেই দুর্ঘটনার ঘটনা বাড়ছে। রেলের রাজস্ব খাতে নিয়োগ না দিয়ে লেভেল ক্রসিংয়ের প্রকল্পগুলোয় ক্রসিংয়ের মানোন্নয়নের চেয়ে লোকবল নিয়োগে ব্যয় বেশি হওয়ায় ক্রসিংয়ের দুর্ঘটনা ঝুঁকি ক্রমেই বাড়ছে বলে মনে করছেন রেলওয়ে-সংশ্লিষ্টরা।

এদিকে রেলওয়ের অধিকাংশ দুর্ঘটনা ঘটছে লেভেল ক্রসিংয়ে। জনবল সংকট, আধুনিক অবকাঠামোহীন নাজুক লেভেল ক্রসিং, অবৈধ লেভেল ক্রসিংয়ের কারণে দুর্ঘটনার ঝুঁকি দিন দিন বাড়ছে। যোগাযোগ করা হলে রেলওয়ের প্রকৌশল বিভাগের একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে বণিক বার্তাকে বলেন, রেলওয়ের জনবল নিয়োগ প্রক্রিয়া দীর্ঘদিন ধরে আটকে রয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে রেলওয়ের নিয়োগ বিধি সংশোধন করা হয়েছে। কিন্তু বর্তমান লেভেল ক্রসিংয়ের অনুপাতে রেলের গেটম্যানের সংখ্যা অপ্রতুল হওয়ায় লেভেল ক্রসিং দুর্ঘটনা কমানো যাচ্ছে না। তাছাড়া প্রায় অর্ধেক লেভেল ক্রসিং চলছে অস্থায়ী গেটম্যান দিয়ে। অস্থায়ী গেটম্যানরা প্রকল্পের অধীনে কম বেতনে ও অনিয়মিত বেতনে চাকরি করায় কাজের প্রতি মনোযোগী না থাকায় দুর্ঘটনা ঝুঁকি কোনোভাবেই এড়ানো যাচ্ছে না।

0Shares

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *