অস্ট্রেলিয়ায় ইসলাম প্রবেশের বৈচিত্র্যময় ইতিহাস

অস্ট্রেলিয়ায় ইসলাম প্রবেশের ইতিহাস দীর্ঘ এবং বৈচিত্রময়। সেখানকার প্রাচীন স্থাপনাগুলি এর সাক্ষী। অস্ট্রেলিয়ার অনেক স্থায়ী অধিবাসী অজ্ঞাত যে,তাদের দেশে খ্রিষ্টানদের বসতি স্থাপন করার পূর্বে এ দেশের অধিবাসিদের মুসলমানদের সাথে এক অবিচ্ছিন্ন যোগাযোগ ও সম্পর্ক ছিলো। উত্তর অস্ট্রেলিয়ার আরহাম দ্বীপের পাথরের উপর অবস্থিত সাদা ও হলদে বর্ণের ছোট ছোট নৌকাগুলো আমাদের কাছে এমন একটি ঘটনার বর্ণনা দেয় যা অধিকাংশ অস্ট্রেলিয়ানরা নিজেদের মায়ের কাছ থেকে জানা ঘটনার বিপরীত।

এগুলো হল ঐতিহ্যবাহী ইন্দোনেশিয়ান নৌকা যা ব্রাউস নামে প্রসিদ্ধ, এগুলো উন্নত ম্যাকাসার শহর (ইন্দোনেশিয়া) থেকে আগত মুসলিম জেলেরা সামুদ্রিক মাছ কিউকুম্বারের সন্ধানে অস্ট্রেলিয়ার উত্তর দ্বীপে আসা যাওয়া করতো। তবে নিশ্চিতভাবে জানা যায়নি যে, প্রথমবার কখন এ সমস্থ মুসলিম জেলেরা ইন্দোনেশিয়ার ম্যাকাসার শহর থেকে এসেছে।

কিছু ঐতিহাসিকরা বলেছেন, এ সমস্থ নৌকাগুলো ১৭৫০ খ্রিষ্টাব্দে এসেছিলো কিন্তু সেখানকার প্রাচীন স্থাপনার উপর কিছু অঙ্কিত চিত্র থেকে জানা যায় তা আরো প্রাচীন। এর মধ্যে একটি চিত্র ১৬৬৪ খ্রিষ্টাব্দের পূর্বে, সম্ভবত ১৫ শ খ্রিস্টাব্দে আকা হয়েছিলো।
পাকিস্তানে গ্যাস লিকেজের ‘রহস্যজনক’ বিস্ফোরণ, নিহত ৬, আহত ১০৩ ≣ স্বাদুপানির মাছ বাড়ার হারে বাংলাদেশ এবার বিশ্বে দ্বিতীয় ≣ [১] ২ মাস ১৫ দিন পর চালু হচ্ছে বুড়িমারী স্থলবন্দরের কার্যক্রম

এ সমস্থ মুসলিম জেলেরা প্রতিবছর সামদ্রিক মাছ কিউকুম্বারের সন্ধানে অস্ট্রেলিয়ার দ্বীপে আসতো।কারন এ মাছটি চীনাদের প্রাকৃতিক ঔষুধ এবং খাবারের জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ ও মুল্যবান ছিলো।

মেলবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞানী ও ইতিহাসবিদ জন ব্যাডলি বলেন, অস্ট্রেলিয়ার অধিবাসিদের সাথে ইন্দোনেশীয়ার জেলেদের যোগাযোগ বা সম্পর্ক অস্ট্রেলিয়ার জন্য প্রথম আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ছিলো। তিনি আরো বলেন, এটি একটি সফল সম্পর্ক ছিলো।তারা ব্যবসা-বাণিজ্য করতো কোনো রাজনৈতিক বা বর্ণগত আইন ছাড়া। এটি ন্যায়সঙ্গত ও ছিলো।

কিন্তু ব্রিটিশরা এর বৈপরীত্য প্রদর্শন করে, তারা অস্ট্রেলিয়াকে জনমানবহীন মরুভূমি বিবেচনা করেছিল।যার কোনো মালিকানা নেই এবং সেখানকার অধিবাসিদের ভুমি অধিকারে স্বীকৃতি বা চুক্তি না করেই বসতি স্থাপন করেছিলো।

ম্যাকাসারদের কিছু ব্যাবসায়ী অস্ট্রেলিয়ায় রয়ে যায়। তারা অস্ট্রেলিয়ার অধিবাসিদের মেয়েদের বিয়ে করেন এবং সেখানে তাদের নিজস্ব সাংস্কৃতিক এবং ধর্মীয় ঐতিহ্য রেখে যান। সেখানকার পাথর এবং অন্যান্য শিল্পকর্মের চিত্র গুলিতে ইসলামের প্রভাব দেখা যায়।

জন ব্যাডলি আরো বলেন,আপনি যদি অস্ট্রেলিয়ার আর্ণহামের উত্তর-পূর্বে ভ্রমন করেন। তবে সেখানে গানে,নৃত্যে, কবিতায় এবং শোকের অনুষ্ঠান গুলিতে ইসলামের প্রভাব দেখতে পাবেন। তিনি বলেন যে, তারা যখন আল্লাহর তাসবিহ পড়ে বা আল্লাহর জন্য ইবাদত বা নামাজ পড়ে, এগুলো শুনলে বা দেখলেই বুজতে পারবে যে,এগুলো বিদেশ থেকে আমদানিকৃত সাংস্কৃতি বা ধর্মীয় ঐতিহ্য।

আর্ণহামের উত্তর উপকূলের এলকো দ্বীপের বাসিন্দা ইউলোঙ্গা উপজাতির দ্বারা তৈরিকৃত “ওয়ালিদা ওয়ালিদা” প্রতিমাটি এর উদাহরণ। এ প্রতিমার নাম আরবী বাক্য “আল্লাহ তায়ালা” থেকে নেওয়া হয়েছে,যার অর্থ ইশ্বর বা সর্ব শক্তিমান। “ওয়ালিদা ওয়ালিদা” এ শব্দটি তারা শোকের অনুষ্ঠানে ব্যবহার করে থাকে। মুসলমানরা যেভাবে নামাজের সময় কিবলার দিক হয়ে সিজদার অনুরুপ অঙ্গভঙ্গি এখানকার অধিবাসিদের রীতি, যার উপর ইসলামের প্রভাব স্পষ্ট।

অস্ট্রেলিয়ার জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞানী হাওয়ার্ড মারফি বলেন,ইউলোঙ্গ উপজাতিরা প্রকৃত আল্লাহর ইবাদত করতো ঠিক কিন্তু তারা এর সামাঞ্জস্য একটি মূর্তিকে ওসিলা মেনে এর পূজা বা ইবাদত করতো যেমনটা তারা বিশ্বাস করতো।

১৯০৬ সালে উচ্চ শুল্ক আদায় এবং কৃষ্ণাঙ্গদের সাথে ব্যবসা বাণিজ্য সীমাবদ্ধতার কারনে অস্ট্রেলিয়ার অধিবাসী এবং স্ট্রেইট অব টরিসের জনগণের সাথে ম্যাকাসার মুসলিম জেলেদের সম্পর্ক শেষ হয়। তবে একি শতাব্দীরও পরে ম্যাকাসারদের সাথে ভাগ করা ইতিহাস উত্তর অস্ট্রেলিয়ার কিছু অধিবাসিরা উদযাপন করে থাকে। তাদের উভয়ের সম্পর্কের এ সময়টাকে শ্রদ্ধার এবং সম্মানের বলে বিবেচনা করেন। যদিও ইতিহাস থেকে জানা যায় যে, তাদের এ সম্পর্ক সর্বদা এমন ছিলো না।

অস্ট্রেলিয়ার অধিবাসিদের সাথে মুসলমানদের সম্পর্ক কেবল এটিই ছিলো না। উনবিংশ শতাব্দীর শেষে বিংশ শতাব্দীর শুরুতে ঝিনুকের মুক্তা শিল্প প্রসার লাভ করেছিলো। এ সময় দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া থেকে মালয়েশিয়ার শ্রমিকরা অস্ট্রেলিয়ার উত্তর-পশ্চিম উপকূলে কাজ করতে আসতো। মালয়েশিয়ানরা ম্যাকাসারদের মতো এখানকার মেয়েদের বিয়ে করার মাধ্যমে তাদের রীতি নীতি এবং ধর্মীয় ঐতিহ্য এ অঞ্চলে নিয়ে আসে। তাদের বিবাহের উত্তরাধিকার সূত্রে বর্তমানে উত্তর অস্ট্রেলিয়ার মানুষের নামে দোলা,হাসান ও খানের প্রভাব দেখা যায়।

এদিকে অস্ট্রেলিয়ার শুকনো মরুভূমিতে মুসলমানদের পৃথক আরেকটি দলের আগমন ঘটে। অস্ট্রেলিয়ার প্রাণকেন্দ্রে অলিস স্প্রিংয়ে ২৬ হাজার লোকের শান্ত একটি শহর। সেখানে অসাধারণ একটি বিল্ডিং রয়েছে।এটি একটি মসজিদ এর মিনারগুলি এতো সুউচ্চ যে,পাশে থাকা “ম্যাকডুনাল র‍্যাঙ্কস” উচু পাহাড়ের পিছন থেকেও দেখা যায়। অত্র মসজিদটি কে “আফগান মসজিদ” বলা হয়ে থাকে। ১৮৬০ এবং ১৯৩০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে ৪ হাজার উষ্ট্রীচালক তাদের উটগুলি নিয়ে অস্ট্রেলিয়ায় আসছিলো। তাদের বেশির ভাগ আফগানিস্তান থেকেই এসেছিল। তবে কিছু ভারত এবং বর্তমান পাকিস্তান থেকেও এসেছিলো।

এই উঠগুলি মরুভূমির রাস্তা পরিস্কার করার ক্ষেতে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলো এবং “ঘান” রেলপথের মতো গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো প্রতিষ্ঠা করেছিলো, যা বর্তমানে ও রেলপথ হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। আফগানিরা অস্ট্রেলিয়ায় অনেক মসজিদ নির্মাণ করেন।কিন্তু অলিস শহরের মসজিদটি হচ্ছে তাদের প্রথম মসজিদ যেখানে তাদের পুর্বপুরুষদের স্মৃতি বিজড়িত তাই তারা এখানে প্রতিবছর এক সাথে মিলিত হয়ে তা’লিম করে আফগানি ঐতিহ্য পালন করে।

অস্ট্রেলিয়ার অধিবাসিরা খ্রিষ্টান ধর্মে ধর্মান্তরিত হলেও বর্তমানে দিন দিন মুসলমানদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ২০১১ সালের আদমশুমারি অনুসারে অস্ট্রেলিয়ার মুসলমানের সংখ্যা ছিলো মাত্র ১১৪০ জন যা ২০০১ সালের আদমশুমারির দ্বিগুণ হয়েছে। বর্তমানে অস্ট্রেলিয়ায় মুসলমানদের সংখ্যা ২০১৬ সালে অস্ট্রেলিয়ার আদমশুমারি প্রকাশ করে। যেখানে ৬ লক্ষ ২ হাজার ৪ শ জন বা ২.৬% মসলিমদের সংখ্যা উল্লেখ করা হয়েছে। যা ইতিপূর্বেই ইতিহাসের সব রেকর্ড ভেঙ্গে দিয়েছে। কিছু গবেষক বলেছেন অস্ট্রেলিয়ায় দ্রুত বৃদ্ধি হওয়ার দিক থেকে ইসলাম ধর্ম প্রথম রয়েছে। যদিও খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বী ৫২% রয়েছে।

ভিক্টোরিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞানী পেটা স্টিফেনসনের মতে,অস্ট্রেলিয়ার অধিবাসী এবং ইসলামি বিশ্বাসীদের মধ্যে ঘটনাগুলি কাকতালীয় বা অস্বাভাবিক কোন বিষয় নয়। বর্তমানে অস্ট্রেলিয়ায় মুসলিম ঐতিহ্যের মধ্যে রয়েছে পুরুষের খাতনা করা, বাবা-মায়ের মাধ্যমে বিবাহ করা,বহু বিবাহ এবং প্রবীণদের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ ইত্যাদি। বর্তমানে অস্ট্রেলিয়ায় অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে মুসলিদের সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে যা মুসলিমদের বিপ্লব হিসেবে অনেক উল্লেখ করছেন।

0Shares

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *