উত্তর কুমারের প্রয়াণের পর চার দশক অতিক্রান্ত হলো। তার অভিনয় জীবনের উত্কৃষ্ট সময় অতিবাহিত হয়েছিল এরও প্রায় এক দশক আগে। সুতরাং আজকের দিনে দাঁড়িয়ে অভিনয় শিল্পী হিসেবে তার মূল্যায়নে আমাদের কোনো দ্বিধা থাকা অনুচিত। উত্তম কুমারের প্রয়াণের দুইদিন বাদে তাকে নিয়ে ‘অস্তমিত উত্তম’ শিরোনামে ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’য় কলম ধরেছিলেন সত্যজিৎ রায়। সেখানে উত্তম কুমার সম্পর্কে তার দ্বিধাহীন মন্তব্য ছিল—‘উত্তমের অভিনয়ের পরিধি যে খুব বিস্তৃত ছিল তা নয়, কিন্তু তার এই নিজস্ব পরিধিতে ক্রমান্বয়ে ৩০ বছর ধরে সে যে নিষ্ঠা ও ক্ষমতার পরিচয় দিয়ে গেল, তার তুলনা নেই। তার অভাব পূরণ করার মতো অভিনেতা আজ কোথায়?’ তাকে নিয়ে এ মূল্যায়নের একদিকে যেমন ফুটে উঠেছে অধিকাংশ চলচ্চিত্রে রোমান্টিক চরিত্রে উত্তম কুমারের অভিনয় প্রসঙ্গে প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত; তেমনি অন্যদিকে রয়েছে অভিনেতা হিসেবে তার কুশলতা ও সাফল্যের কুণ্ঠাহীন স্বীকৃতি। সত্যজিৎ রায়ের মূল্যায়নকে মান্য বিবেচনা করেও এটি ব্যক্ত করা চলে যে উত্তম কুমার ছিলেন নিঃসন্দেহে একজন বড় মাপের অভিনয় শিল্পী। আবার কেবল চলচ্চিত্রে, থিয়েটারেও নিরন্তর-উত্কৃষ্ট অভিনয়ের অভ্যন্তরেই নয়, তার আজীবনের সংগ্রামের মধ্যেও প্রত্যক্ষ করা যায় এই বড় শিল্পী হয়ে ওঠার মৌলবীজ, গড়নের রূপরেখা, ইতিহাস। যার ক্রমিক আলোচনায় খুঁজে পাওয়া সম্ভব একজন অদ্বিতীয় উত্তম কুমারকে, যার মতো আর কেউ ছিলেন না, খুব সম্ভবত যার মতো আর কেউ হবেন না।
উত্তম কুমার অভিনয় জীবনে প্রবেশ করেছিলেন গত শতাব্দীর চল্লিশের দশকের মধ্যপাদে। উত্তম কুমার ছিলেন সেই বড় ও মহৎ শিল্পীদের অন্যতম, যারা একদিনে কিংবা রাতারাতি সাফল্য, প্রতিষ্ঠা অর্জন করতে সক্ষম হননি। বরং নিষ্ঠতা অবলম্বন করে কাজের প্রতি অনুরক্ত থেকেছেন নিরবচ্ছিন্নভাবে, অশেষ সংযমে। কালের আগুনে, যুগবাস্তবতার পর্বে পর্বে পুড়ে পরিণত হয়েছেন খাদহীন সোনায়। অভিনয় জীবনের প্রাথমিক পর্বে উত্তম কুমারকে অতিক্রম করতে হয়েছিল নিতান্তই বন্ধুর পথ, প্রতিকূলতার। চল্লিশের দশকে ‘দৃষ্টিদান’, ‘মায়াডোর’, ‘কামনা’র তুল্য চলচ্চিত্রগুলোয় তার বিফলতা আমাদের অবিদিত নয়। যার ফলে কলকাতার চলচ্চিত্র পাড়ায় আড়ালে তার নাম দাঁড়িয়ে গিয়েছিল ‘ফ্লপ মাস্টার জেনারেল’। তবে ব্যক্ত করার বিষয় এটিই যে উত্তম কুমার হার মানেননি, অনেকের তুল্য নিমজ্জিত হননি হতাশার চোরাবালিতে। বরং নিজেকে প্রতিষ্ঠা করার সংগ্রামটা চালিয়ে গেছেন নিরন্তর।
পঞ্চাশের দশকের প্রথমপাদের ‘সাড়ে চুয়াত্তর’ থেকে সত্তরের দশকের অন্তিমপাদের ‘ওগো বধূ সুন্দরী’ অবধি উত্তম কুমারের যে যাত্রা, সেখানে তিনি ২০০-এর অধিক চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন। একজন প্রতিশ্রুতিশীল, উত্কৃষ্ট অভিনেতার জন্য সংখ্যাটা অতিরিক্ত মনে হওয়া মোটেও অস্বাভাবিক নয়। আবার অন্যপ্রান্তে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, বিশ্বজিৎ চট্টোপাধ্যায়, অনিল চট্টোপাধ্যায়, বসন্ত চৌধুরী, শমীত ভঞ্জের তুল্য ডাকসাইটে অভিনেতাদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এতগুলো চলচ্চিত্রে নায়কের ভূমিকায় অভিনয় করা অভিনেতা হিসেবে তার অনিবার্যতা স্বীকার করতে আমাদের বাধ্য করে।
একপ্রান্তে তিনি যেমন প্রকৃত অভিনয় প্রতিভার প্রকাশ ঘটিয়েছেন, তেমনি অন্যপ্রান্তে লাভ করতে সক্ষম হয়েছেন দর্শক সমাজের অকুণ্ঠ ভালোবাসা, গ্রহণযোগ্যতা আর শ্রদ্ধা। উত্তম কুমারের অভিনয়ের সবচেয়ে বিশিষ্টতা প্রসঙ্গে যদি আলোচনা করতে হয়, তবে সেটি নিঃসন্দেহে চলচ্চিত্রে তার রোমান্টিক বাতাবরণ, আবহ, প্রতিবেশ তৈরি করার সক্ষমতা। এই অদ্বিতীয় সক্ষমতার পরিচয় যে তিনি কেবল সুচিত্রা সেনের সঙ্গে অভিনীত চলচ্চিত্রগুলোতেই রাখতে সক্ষম হয়েছেন, এটি একপ্রকার খণ্ড বিবেচনা। এক্ষেত্রে সুপ্রিয়া দেবী, সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়, তনুজা, মিঠু মুখার্জী, শর্মিলা ঠাকুর থেকে মৌসুমী চ্যাটার্জিদের সঙ্গে অভিনীত চলচ্চিত্রগুলোও বিস্মৃত হওয়ার নয়; বরং উত্কৃষ্ট কাজের দ্যোতক। যার মাধ্যমে তার অভিনয় দক্ষতার আরেক প্রস্থ পরিচয় আমরা লাভ করতে পারি। নায়িকাদের সামনে, নায়কের যে আড়ষ্ঠতাবর্জিত, সাবলীল অঙ্গভঙ্গির অভিনয়, তারও প্রকৃত পথপ্রদর্শক উত্তম কুমার, যা উত্তরকালে বাংলা চলচ্চিত্রে নায়ক চরিত্রের সবচেয়ে বিশিষ্ট গুণ বলে বিবেচিত-বিচার্য হয়েছে, মান্যতা পেয়েছে।
উত্তম কুমারকে কেবল রোমান্টিক নায়কের পরিচয়ে সীমাবদ্ধ রাখলে তার অভিনয় প্রতিভার প্রতি খানিকটা অবিচার করা হবে। খুব বেশি চলচ্চিত্রের নাম না করেও রোমান্টিক নায়কের বাইরে সলিল সেনের ‘রাজকুমারী’ চলচ্চিত্রে হূদয়হরণ চরিত্রে তার কৌতুক অভিনয় ও সত্যজিৎ রায়ের ‘নায়ক’ চলচ্চিত্রে অরিন্দম মুখার্জী চরিত্রে বাস্তবনিষ্ঠ অভিনয় প্রত্যক্ষ করলে আমাদের এমন ভাবনা-ধারণা অনায়াসেই অপসৃত হতে বাধ্য। তার অভিনীত কয়েকটি খল চরিত্রকেও এক্ষেত্রে উদাহরণরূপে মান্য করা যেতে পারে। আমরা জানি, উত্তম কুমারের প্রতিভা ছিল মৌলত দুটি। একটি গানের, অন্যটি অভিনয়ের। তিনি অভিনয়ের কারণে গানকে ত্যাগ করেছিলেন। উপলব্ধি করেছিলেন অভিন্ন ব্যক্তির একাধিক প্রতিভা থাকলেও তাকে সাফল্য অর্জন করতে হলে অবলম্বন করতে হবে একটি পথকেই। এক্ষেত্রেও বাংলা চলচ্চিত্র ও সংগীতের তিনি এক ব্যতিক্রমী, অদ্বিতীয় উদাহরণ। কারণ তার সম্মুখবর্তী অনেক শিল্পীকেই আমরা অভিনেতা ও গায়ক দুটো ভূমিকাই চালিয়ে যেতে দেখেছি। এমনকি পঙ্কজ কুমার মল্লিক, কুন্দল লাল সাইগাল, কৃষ্ণচন্দ্র দে’দের গায়ক পরিচিতির চোরাবালিতে ক্রমে লুপ্ত হয়েছে তাদের অভিনেতা পরিচয়। অভিনেতাদের পরিচিত জনপ্রিয়তা ও তথাকথিত সামাজিকতার পরিমণ্ডলেও তিনি ছিলেন এক অদ্বিতীয় উদাহরণ, বিরল ব্যতিক্রম। আমাদের অবিদিত নয়, ষাটের দশকের প্রথমপাদে তিনি স্ত্রী গৌরী দেবীর সংসার পরিত্যাগ করে একত্রে বাস করতে আরম্ভ করেন সুপ্রিয়া দেবীর সঙ্গে। তাদের অভ্যন্তরে কোনো বৈবাহিক সম্পর্ক ছিল না। সমাজ ও জনপ্রিয়তার দিকে না তাকিয়ে এমন সাহসী পদক্ষেপের নজির উত্তম কুমার ব্যতিরেকে বাংলা চলচ্চিত্রে আর কোনো অভিনেতার মধ্যেই লভ্য নয়, এমনকি একালেও। আমরা জানি, অভিনয়ের সমান্তরালে তিনি চলচ্চিত্র প্রযোজনা, পরিচালনা ও সুরযোজনার কাজেও নিজেকে সংশ্লিষ্ট করেছিলেন, সফল হয়েছিলেন। এদিকেও শিল্পী হিসেবে তার প্রতিভার দ্যোতনা বহন করে। তবু উত্তম কুমার তার প্রতিভার, কুশলতার সবটুকু অভিনয়ের জন্য দিয়ে যেতে পারেননি দুটি কারণে। প্রথমত উত্কৃষ্ট পরিচালকের অভাবে, দ্বিতীয়ত তার অকাল প্রয়াণের ফলে। একজন উত্তম কুমারের অদ্বিতীয় উপস্থিতি মান্য জেনেও বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে এ দুটি আক্ষেপ রয়ে যাবে।