শীতের আমেজে পাটালি গুড় তৈরিতে ব্যস্ত গাছিরা

গুড়া: ঋতুচক্রে কার্তিক-অগ্রহায়ণ হেমন্তকাল। কার্তিক পেরিয়ে বর্তমানে অগ্রহায়ণ চলমান রয়েছে।

হেমন্তের মাঝামাঝি থেকে হালকা শীত পড়তে শুরু করে। একইসঙ্গে প্রকৃতিতে শিশিরবিন্দু জানান দেয় শীতের আগমনী বার্তা। আর সেই শীতের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে খেজুর রসের। এরইমধ্যে বগুড়ায় খেজুর রসের পাটালি গুড় তৈরিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন গাছিরা।

প্রকৃতিতে শীতের আবহ শুরু হয়ে দিন দিন তা বেড়েই চলছে। শীতের আগমনে বেশ কিছুদিন ধরেই শুরু হয়েছে খেজুর রস সংগ্রহের কাজ। প্রতি বছরের মতোই কার্তিক মাস (অক্টোবর-নভেম্বর) থেকে রস সংগ্রহের জন্য খেজুর গাছ প্রস্তুতের কাজ করে আসছে গাছিরা।

বুধবার (২৪ নভেম্বর) জেলার কয়েকটি উপজেলা ঘুরে দেখা গেছে, খেজুর রস থেকে গুড় তৈরিতে গাছিদের নানা কর্মকাণ্ড।

বগুড়া জেলার ১২টি উপজেলার মধ্যে কাহালু, শেরপুর, নন্দীগ্রাম, শাজাহানপুর, আদমদীঘি বরেন্দ্রখ্যাত উপজেলা হিসেবে পরিচিত। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালকের কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, এসব উপজেলাসহ অন্যান্য উপজেলা মিলে বগুড়ায় প্রায় ৪৪ হাজারের মতো খেজুর গাছ রয়েছে। তবে কালের আবর্তে গাছের সংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে।

এ জেলায় চিরাচরিত সনাতন পদ্ধতিতেই মাটির ভাঁড়ে রাতভর রস সংগ্রহ করা হয়। ভোরের সূর্য ওঠার আগে গাছিরা রসভর্তি মাটির ভাঁড় গাছ থেকে নামিয়ে মাটির হাঁড়িতে কিংবা টিনের বড় তাওয়ায় জ্বাল দিয়ে গুড়-পাটালি ও লালি তৈরি করেন। নতুন খেজুর রসের গুড়-পাটালি তৈরির পর তা চলে যাচ্ছে বাজারে।

এখন গ্রামের ঘরে ঘরে খেজুর রসের পিঠা, পায়েস, গুড়ের মুড়ি-মুড়কি ও নানা ধরনের মুখরোচক খাবার তৈরি করার ধুম পড়েছে। বাজারে চিনির দাম তুলনামূলক কম হলেও পাটালি গুড়ের চাহিদা কমেনি বলে জানিয়েছেন স্থানীয় গাছিরা।

প্রতি বছরের মতো এবারও রাজশাহী জেলার বাঘা উপজেলার আরপাড়া গ্রামের মহররম আলীর ছেলে গাছি মো. মিন্টু আলী (৪৯) পাটালি গুড় তৈরির কাজে চলে এসেছেন বগুড়ার কাহালু উপজেলার বান্দাগারা এলাকায়। একই গ্রামের ফজলু তার সঙ্গে গুড় তৈরির কাজ করে আসছেন নিয়মিতভাবে। তবে দু’বছর আগে তাদের চার জনের একটি দল ছিল। দুইজন অন্যত্র চলে যাওয়ায় এখন মিন্টু ও ফজলু দু’জনের দল বেঁধেছে।

গাছি মিন্টু ও ফজলু বাংলানিউজকে জানান, গত সাত বছর ধরে তারা বগুড়া কাহালু উপজেলায় নিয়মিত আসেন গুড় তৈরির কাজে। এটিই তাদের ব্যবসা। স্থানীয় বাসিন্দাদের খেজুর গাছ থেকে রস সংগ্রহ করে, তা থেকে পাটালি গুড় ও স্থানীয় ভাষায় লালিগুড় তৈরি করে বাজারে বিক্রি করেন। গেল বছর মোট ১৪০টি গাছের রস সংগ্রহ করা হয়েছে। রস উৎপন্ন করতে গাছের পরিচর্যায় প্রচুর সময় লাগে, তাই সব মিলিয়ে চার মাস বগুড়ায় থাকতে হয় তাদের।

তারা জানান, আশ্বিনের শুরু থেকে গাছের পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার কাজ শুরু করেন। এ বছর মোট ১৬০টি গাছ রস উপযোগী করেছেন। প্রস্তুত করা প্রতিটি গাছ থেকে সপ্তাহে দুই-তিনদিন রস সংগ্রহ করা হয়। প্রতিটি গাছে শুরুতে এক থেকে দুই কেজি করে রস সংগ্রহ হলেও আস্তে আস্তে তা বাড়ে। প্রতিদিন ধাপে ধাপে সম্পূর্ণ গাছের রস সংগ্রহ করেন।

তারা আরও জানান, প্রথমদিকে প্রতিদিন আনুমানিক পাঁচ কেজি করে পাটালি গুড় তৈরি হয়। তারপর মাঝামাঝি থেকে পুরো মৌসুমে প্রতিদিন ৫০ কেজি থেকে ১২০ কেজি পাটালি ও লালি তৈরি করা হয়। প্রতি কেজি পাটালি ও লালিগুড় বাজারে পাইকারদের কাছে মানভেদে ১২০ থেকে ২০০ টাকায় বিক্রি করা হয়।

গাছ মালিকদের বিষয়ে জানতে চাইলে ফজলু মিয়া জানান, রস থেকে গুড় তৈরির জন্য স্থানীয়দের মোট ১৬০টি গাছের মালিকদের সঙ্গে চুক্তি করা আছে। এর মধ্যে কোনো ব্যক্তির ১টি বা ২টি, আবার কারো ২০-৩০টি করে গাছ আছে। তাদের এ মৌসুমে প্রতিটি গাছের জন্য ১৮০-২২০ টাকা বা দেড় থেকে দু’কেজি নালিগুড় দিতে হবে। তবে এ বছর গুড় তৈরির স্থানের জন্য ভাড়া গুনতে হচ্ছে না। গেল বছর একই উপজেলার পাতঞ্জা এলাকায় ৪ হাজার টাকা স্থান ভাড়া দিতে হয়েছে।

গাছিরা জানান, খেজুর গাছ তৈরির প্রস্তুতি সম্পন্ন করার পর থেকেই মূলত রস নামানোর পর্ব শুরু হয়। গাছের মাথার নির্দিষ্ট স্থানে বাঁশের বানানো দু’টি চোখা খুঁটি পোঁতা হয়। সঙ্গে দড়ি বা সুতা বেঁধে মাটির পাত্র ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। পাত্রের ভেতর রস পড়ার জন্য বাঁশের তৈরি নালার মতো ভিন্ন একটি খুঁটি পুঁতে দেওয়া হয় সেই গাছের সঙ্গে। এভাবেই গাছির নিপুণ হাতের ছোঁয়ায় ফোঁটায় ফোঁটায় ঝরে খেজুর রস।

তারা দুপুরের দিকে নির্দিষ্ট গাছগুলোতে হাঁড়ি ঝুলিয়ে আসেন। এরপর দিনগত রাত ৩টার দিকে গাছ থেকে রস নামানোর প্রস্তুতি নেন। ভোর হতেই সব গাছের রস সংগ্রহ করে তা টিনের বড় তাওয়ায় জ্বাল দেন। এ সময় তাওয়াতে থাকা রস অনবরত নাড়তে হয়। জ্বালানি হিসেবে খড়, খেজুর ও তাল গাছের শুকনো ডাল-পাতা ব্যবহার করেন। রস জ্বালের ঘণ্টাখানেক পর রস ঘন হয়। এরপর তা নামিয়ে একটি গোলাকার হাঁড়িতে ঢেলে বাঁশের একটি সরু লাঠি দিয়ে ঘোরানো হয়। এক পর্যায়ে সেগুলোর ঘনত্ব আরও বেশি হয় এবং তা কাঠের তৈরি চারকোনা বিশিষ্ট খোপের মধ্যে ঢেলে পাটালির আকার দেওয়া হয়।

একদিকে ব্যবসা আগের মতো নেই। অন্যদিকে রাত-দিন এক করে এ কাজ করতে হয়। কাজ শুরুর আগেই পাইকারদের থেকে টাকা ধার নিয়ে চলতে হয়। তাই, গুড়গুলো পাইকারদের কাছেই বিক্রি করতে হয়। ফলে তেমন লাভবান হওয়া যায় না বলেও মন্তব্য করেন তারা।

বগুড়া জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক কৃষিবিদ মো. ফরিদুর রহমান বাংলানিউজকে জানান, নভেম্বর থেকে শুরু করে মোটামুটি ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত খেজুর রস সংগ্রহ করা যায়। ইতোমধ্যেই জেলার বিভিন্ন উপজেলায় গাছিরা এই রস সংগ্রহ ও গুড় তৈরি করছেন। সাধারণত বাণিজ্যিকভাবে কেউ খেজুর গাছ লাগায় না। প্রাকৃতিকভাবেই এসব খেজুরগাছ জন্ম নিয়েছে। পতিত জমি, ভিটা, জমির আইলসহ বিভিন্ন স্থানে এসব খেজুর গাছের দেখা মেলে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

এ জেলায় একটা সময় বিপুল সংখ্যক খেজুর গাছ ছিল। মানুষ সিংহভাগ খেজুর গাছ কেটে ফেলেছেন। এছাড়াও খেজুর গাছের বয়স বাড়ার কারণে সব গাছ থেকে রসের উৎপাদনও হয় না। আবার কিছু কিছু খেজুর গাছ দেখতে অনেক মোটা তাজা হলেও সেই গাছ থেকে রস পাওয়া যায় না বলে মন্তব্য করেন সাধারণ মানুষ।

0Shares

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *