যুক্তরাষ্ট্র ইন্টারনেট ব্যবস্থা বিভক্ত করতে চাইছে?

বিশ্বের প্রভাবশালী অনেক দেশ নিজস্ব ইন্টারনেট ব্যবস্থা কিংবা ‘ক্লিন ইন্টারনেট’ বিষয়টিতে গুরুত্ব দিচ্ছে। এ টার্ম দিয়ে এমন এক ইন্টারনেট ব্যবস্থাকে বোঝানো হচ্ছে, যা একটি দেশের অভ্যন্তরীণ ইন্টারনেট ব্যবস্থাকে বাইরের দেশের প্রভাব বা উদ্দেশ্যমূলক কোনো কনটেন্ট থেকে মুক্ত রাখবে। অর্থাৎ এটি এমন একটি ইন্টারনেট ব্যবস্থা হবে, যা কোনো না কোনোভাবে একটি দেশ পরিচালনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট গোষ্ঠীর ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপর নির্ভর করে গড়ে উঠবে। ক্লিন ইন্টারনেট বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র অনেকটা নড়েচড়ে বসেছে। ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসনের চীনা ইন্টারনেটভিত্তিক প্রযুক্তি সেবা ও অ্যাপ বিষয়ে গৃহীত ক্রমাগত পদক্ষেপে উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে যে যুক্তরাষ্ট্র বৈশ্বিক ইন্টারনেট ব্যবস্থার অখণ্ডিত রূপ বিভক্ত করতে চাইছে। বাস্তবে অখণ্ড ইন্টারনেট ব্যবস্থা বিভক্ত হয়ে একাধিক প্রতিযোগী নেটওয়ার্কে পরিণত হলে তা বৈশ্বিক কানেক্টেড কমিউনিটির জন্য ইতিবাচক হবে না বলে মনে করা হচ্ছে।

সম্প্রতি মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও বলেন, জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে তিনি ক্লিন ইন্টারনেট চান। অর্থাৎ তিনি তার বক্তব্যে বোঝাতে চেয়েছেন যে যুক্তরাষ্ট্রের ইন্টারনেট ব্যবস্থাকে চীন এবং চীনা কোম্পানির প্রভাবমুক্ত দেখতে চান। এটা বাস্তবে রূপ দিতে চাইলে গড়তে হবে নিজস্ব ইন্টারনেট ব্যবস্থা। যেখানে সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ থাকবে মার্কিন প্রশাসনের।

তিনি বলেন, বিশ্বস্ত নয় এমন সব অ্যাপ যুক্তরাষ্ট্রে অ্যাপ স্টোর থেকে সরানো হবে। এছাড়া জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি এমন সব বাইরের প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ক্রমান্বয়ে ব্যবস্থা নেয়া হবে, যা ইন্টারনেটভিত্তিক সেবার ক্ষেত্রে চীনের পথে হাঁটার ইঙ্গিত দেয়।

‘ক্লিন ইন্টারনেট’ টার্মটি বর্তমানে সবচেয়ে বেশি প্রযোজ্য চীন এবং রাশিয়ার ক্ষেত্রে। উভয় দেশ ইন্টারনেট ব্যবস্থার ওপর কড়া নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় সক্ষম হয়েছে। অর্থাৎ এ দুই দেশের সরকার যা চাইবে, নাগরিকরা শুধু সেসব কনটেন্টই ইন্টারনেট ব্যবস্থায় দেখতে পারবেন। চীন ও রাশিয়া নিষিদ্ধ রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক অসংখ্য ইন্টারনেটভিত্তিক সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম। মেসেজিং, সোস্যাল মিডিয়ার পাশাপাশি সার্চ সেবার ক্ষেত্রেও এ দুই নিজস্ব ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে, যা অখণ্ডিত ইন্টারনেট বিশ্বের জন্য এক ধরনের হুমকি মনে করা হচ্ছে।

গত জানুয়ারির শেষ দিকে সুইজারল্যান্ডের দাভোসে অনুষ্ঠিত ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামে ‘ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিস’-এর মহাপরিচালক এবং শীর্ষস্থানীয় ইন্টারনেট বিশেষজ্ঞ জন চিপম্যান টেকনোলজি কোল্ড ওয়্যারের বৈশ্বিক প্রভাব নিয়ে এক প্যানেল আলোচনায় সতর্ক করে বলেন, যুক্তরাষ্ট্র-চীনের বাণিজ্য বিরোধ ও হুয়াওয়েসহ চীনা অন্য কোম্পানিগুলোর ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞার কারণে বৈশ্বিক ইন্টারনেট ব্যবস্থা বিভক্ত হয়ে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রকেন্দ্রিক হয়ে উঠলে চীনা সংস্করণ বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলোয় বেশি আকর্ষণীয় হবে।

তিনি বলেন, অখণ্ড ইন্টারনেট ব্যবস্থার সুযোগ-সুবিধা বিশ্বের সব দেশই দেখতে পারছে। কিন্তু তা বিভক্ত হয়ে গেলে সুযোগ-সুবিধাও বিভক্ত হওয়ার পাশাপাশি সীমাবদ্ধতার মধ্যে চলে আসবে। বৈশ্বিক অর্থনীতি বিষয়ে আগ্রহী চীন এখনো অখণ্ড ইন্টারনেট ব্যবস্থার মধ্যে থাকলেও তারা বসে নেই। চীনের প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলো মার্কিন যেকোনো প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে টেক্কা দেয়ার সক্ষমতা অর্জন করেছে। এমনিতেও দেশটিতে জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে ইন্টারনেট ব্যবস্থার ওপর কঠোর নজরদারি প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। অর্থাৎ অখণ্ড ইন্টারনেট ব্যবস্থাকে দ্বিখণ্ডিত বা ‘স্প্লিন্টারনেট’ করা হলে বিশ্বের ইন্টারনেট জনসংখ্যা দুই বা ততোধিক ইন্টারনেট সংস্করণ দেখতে পাবে।

দ্বিখণ্ডিত বা স্প্লিন্টারনেট ইন্টারনেট ব্যবস্থায় যে সমস্যাগুলোর মুখোমুখি হতে হবে, তা হলো কনটেন্ট সরবরাহ চেইন সম্পূর্ণ বদলে যাবে এবং কম্পিউটার সিস্টেম তৈরি হবে সম্পূর্ণ ভিন্ন স্ট্যান্ডার্ডে। ফলে ইন্টারনেট প্রযুক্তি, সফটওয়্যার ও অন্যান্য ইন্টারনেট অবকাঠামো একসঙ্গে কাজ করতে পারবে না। অর্থাৎ ভিন্ন ইন্টারনেট স্ট্যান্ডার্ডের জন্য ভিন্ন ইন্টারনেট প্রযুক্তি, সফটওয়্যার ও ইন্টারনেট অবকাঠামোর প্রয়োজনীয়তা দেখা দেবে।

বিশেষজ্ঞদের দাবি, দ্বিখণ্ডিত ইন্টারনেট ব্যবস্থায় প্রত্যেক সেবাদাতা সিস্টেম ব্যবসায় দিক থেকে সফল হতে চাইবে। তবে চীনের ইন্টারনেট ব্যবস্থার এগিয়ে থাকার সম্ভাবনা বেশি। চীনা ব্র্যান্ডগুলো সবচেয়ে সাশ্রয়ী তথ্যপ্রযুক্তি পণ্য দিয়ে বিশ্বের উদীয়মান দেশগুলোয় আধিপত্য বিরাজ করেছে। কাজেই দেশগুলোয় নিজস্ব ইন্টারনেট ব্যবস্থার সম্প্রসারণ দেশটির জন্য প্রতিযোগীদের চেয়ে সহজ হবে।

ইন্টারনেট ব্যবস্থায় সার্বভৌম ক্ষমতা অর্জনের আকাঙ্ক্ষা বিশ্বে নতুন নয়। এখন পর্যন্ত চীন এ লক্ষ্যে অন্য সবার চেয়ে এগিয়ে। যুক্তরাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত বৈশ্বিক ইন্টারনেট ব্যবস্থা থেকে চীনের নিজেকে বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা বেশ পুরনো, যা ‘দ্য গ্রেট ফায়ারওয়াল অব চায়না’ নামে পরিচিত। এটা একটা সেন্সরশিপ ব্যবস্থা। স্বাধীন মত প্রকাশে চীনের জনগণের ওপর এ সেন্সরশিপ নিয়ে বিতর্ক থাকলেও প্রকল্পটির অর্থনৈতিক প্রভাব বেশ গভীর। এ কৌশল অবলম্বন করে চীন ইন্টারনেটভিত্তিক শত কোটি ডলার মূল্যের একাধিক প্রতিষ্ঠান গড়তে পেরেছে।

গত বছর ‘নিজস্ব ইন্টারনেট’ তৈরিতে দৃশ্যমান পদক্ষেপ নিয়েছিল রাশিয়া। দেশটির প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন গত বছরের এপ্রিলে এমন ব্যবস্থা তৈরির জন্য নতুন আইন পাস করিয়েছেন। একই পথে এগোচ্ছে ইরানও। গত বছরের দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতে ইরান ঘোষণা দিয়েছিল, তারা ‘জাতীয় তথ্য নেটওয়ার্ক’ প্রকল্পের কাজ ৮০ শতাংশ শেষ করেছে। এ প্রকল্প দেশটির ‘নিজস্ব ইন্টারনেট’ ব্যবস্থা গড়ার অংশ।

বিভিন্ন দেশের সামরিক বাহিনীর ক্ষেত্রে ‘স্প্লিন্টারনেট’ ব্যবস্থা চালু হয়ে গেছে। গত জানুয়ারিতে তাইওয়ানভিত্তিক সেমিকন্ডাক্টর কোম্পানি টিএসএমসিকে সামরিক বাহিনীর জন্য সরবরাহকৃত চিপ যুক্তরাষ্ট্রে উৎপাদনের নির্দেশ দিয়েছে ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসন। কারণ টিএসএমসির তৈরি চিপ যুক্তরাষ্ট্রের এফ-৩৫ ফাইটার জেটে ব্যবহূত হয়। টিএসএমসি চীনভিত্তিক হুয়াওয়েরও চিপ সরবরাহকারী।

চীনের পাশাপাশি যদি রাশিয়া ও ইরান নিজস্ব ইন্টারনেট ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার চেষ্টায় সফল হয়, তাহলে ভবিষ্যতে এমন এক ইন্টারনেট ব্যবস্থা তৈরি হবে, যেটার সঙ্গে এখনকার ইন্টারনেট ব্যবস্থার কোনো কিছুরই মিল থাকবে না। এ চেষ্টার পেছনে বিশাল প্রযুক্তিগত চ্যালেঞ্জ, অনেক অর্থনৈতিক বিষয় জড়িত। তবে নিজস্ব ইন্টারনেট ব্যবস্থা গড়ে তোলা অসম্ভব নয়।

0Shares

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *