মাতৃত্বকালীন ছুটি ও ভাতা পান ৩% নারীশ্রমিক

পোশাক খাতে কর্মরত নারীশ্রমিকদের মধ্যে প্রতি বছর মা হন ৮ দশমিক ৩ শতাংশ। কিন্তু তাদের মধ্যে মাতৃত্বকালীন ছুটি ও ভাতা পান মাত্র ৩ দশমিক ১ শতাংশ নারীশ্রমিক।

পোশাক খাতে কর্মরত শ্রমিকদের নিয়ে এশিয়ান সেন্টার ফর ডেভেলপমেন্টের (এসিডি) সাম্প্রতিক গবেষণায় এমন চিত্র উঠে এসেছে।

ভাতাসহ মাতৃত্বকালীন ছুটির ব্যাপারে আরো মানবিক হওয়ার পরামর্শ দিয়ে এসিডির গবেষণাপত্রে সুপারিশ করে বলা হয়েছে, মাতৃত্বকালীন ছুটি ও ভাতা পাওয়া নারীশ্রমিকদের অধিকার। এ ব্যাপারে গার্মেন্টস মালিকরা আরো যত্নবান হলে শ্রমিক-মালিক দু’পক্ষই লাভবান হবেন।

ছুটির জন্য যে কাজের ক্ষতি হয় না—তার যৌক্তিকতা দেখিয়ে গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, একজন শ্রমিক বছরে ৪ দশমিক ৭ দিন ছুটি পান। ৯৮ দশমিক ৪ শতাংশ শ্রমিক এ সাধারণ ছুটি ভোগ করেন। কিন্তু সপ্তাহের বাকি ছয়দিন তারা দৈনিক ৯ ঘণ্টার মতো কাজ করেন। এতে দেখা যায়, প্রতি সপ্তাহে তারা ৮ ঘণ্টা ৩০ মিনিট অতিরিক্ত কাজ করেন, যা ছুটি ভোগের একদিনের চেয়েও ৩০ মিনিট বেশি। এর মানে দাঁড়ায় বছর শেষে ৭৩ শতাংশ শ্রমিক অতিরিক্ত সময় কাজ করেন।

বাংলাদেশ গার্মেন্ট ম্যানুফ্যাকচার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজিএমইএ) নথিভুক্ত পোশাক কারখানার প্রত্যেকটি থেকে দৈবচয়নে ছয় থেকে আটজন শ্রমিকের সঙ্গে কথা বলে এ জরিপ পরিচালনা করে এসিডি। ‘সোসিও-ইকোনমিক প্রোফাইল অব গার্মেন্ট ওয়ার্কার্স অব বাংলাদেশ’ শিরোনামে জরিপ প্রতিবেদনে বৈচিত্র্য রক্ষার্থে একেক কারখানার একেক সেকশনের শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলা হয়। কভিড-১৯-এর আগে জরিপ কার্যক্রম শুরু হলেও গত বছরের মার্চে মাঠপর্যায়ের গবেষণা বন্ধ করে দেন এসিডির গবেষকরা। পরে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে ভার্চুয়াল যোগাযোগের মাধ্যমে জরিপটি সম্পন্ন করা হয়।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যে কর্মস্থলে উপযুক্ত পরিবেশ জরুরি। সেক্ষেত্রে ৮০ শতাংশ শ্রমিক বলেছেন, কর্মস্থলে তারা কাজের পরিবেশ, পর্যাপ্ত আলো, জরুরি বহির্গমন পথ, ওয়াশরুম ও ক্যান্টিন সুবিধা পান। কিন্তু কর্মস্থলে যাতায়াতের ক্ষেত্রে ৮০ শতাংশ শ্রমিক কোনো ধরনের যাতায়াত সুবিধা তো পানই না, বরং এ বিশালসংখ্যক শ্রমিক হেঁটে কাজে যোগ দেন। গড়ে প্রত্যেক শ্রমিক এক-দুই কিলোমিটার এবং সময়ের হিসাবে ১৯ মিনিট হেঁটে কর্মস্থলে আসেন। অনেক নারীশ্রমিক সঙ্গে ছোট শিশু নিয়ে আসেন। ৮৭ দশমিক ৫ শতাংশ কারখানায় শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র সুবিধা থাকলেও এতটা পথ হেঁটে শিশুকে নিয়ে আসার বদলে বাসায় রেখে আসাই ভালো মনে করেন অনেকে। মাত্র ১১ দশমিক ৭ শতাংশ নারী দিবাযত্ন কেন্দ্র ব্যবহার করেন বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

জরিপ মতে, পোশাক খাতে কর্মরত শ্রমিকদের মধ্যে ৮৪ শতাংশ কারখানার ক্যান্টিন ব্যবহার করেন। ৭৩ শতাংশ ক্যান্টিনে খাবার বিক্রি হলেও মাত্র ২৫ শতাংশ শ্রমিক বাইরে থেকে খাবার কিনে খান। বাকি ৭৫ শতাংশ শ্রমিক বাসা থেকে নিয়ে আসা খাবার খাওয়ার জন্য ক্যান্টিন ব্যবহার করেন।

৫৭ শতাংশ শ্রমিক জানিয়েছেন, কারখানা থেকে প্রাপ্ত বেতন ছাড়া তাদের দ্বিতীয় কোনো আয়ের উৎস নেই। ৪৩ শতাংশ শ্রমিক কৃষিকাজ কিংবা পোলট্রি ফার্ম এবং ৫ শতাংশ শ্রমিক ব্যবসার মাধ্যমে আয় করেন। ৬৫ শতাংশ শ্রমিক জানিয়েছেন, তাদের স্বামী বা স্ত্রীও পোশাকশ্রমিক হিসেবে কাজ করেন।

পোশাক শ্রমিকদের অর্থনৈতিক অবস্থাও উঠে এসেছে জরিপে। তাদের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, ৬৭ দশমিক ২ শতাংশ শ্রমিকের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট আছে। ৩১ দশমিক ৭ শতাংশ শ্রমিক এজেন্ট ব্যাংকিং সেবা নেন। এক্ষেত্রে ৪৩ শতাংশের বিকাশ অ্যাকাউন্ট আছে। কারণ হিসেবে তারা বলেন, সহজলভ্যতার কারণেই বিকাশ ব্যবহারের প্রবণতা তাদের মধ্যে বেশি। মাত্র ৩ দশমিক ১ শতাংশ শ্রমিক নগদ ব্যবহার করেন। টাকা লেনদেনের ক্ষেত্রে ৮২ শতাংশ শ্রমিক মোবাইল ব্যাংকিং ব্যবহার করলেও ১৫ শতাংশ শ্রমিক হাতে হাতে লেনদেন করেন।

পোশাক শ্রমিকদের গড় আয় ১২ হাজার ৫০০ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ১৮ হাজার ৫০০ টাকা। অধিকাংশ শ্রমিক স্বামী-স্ত্রী উভয়ে উপার্জন করেন এবং তাদের মোট গড় উপার্জন ২৩ হাজার টাকা থেকে সর্বোচ্চ ৩৭ হাজার টাকা। ওভারটাইম করে তারা আরো ৯ হাজার ৫০০ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ৩০ হাজার টাকা উপার্জন করেন। ৬৩ শতাংশ নারী উপার্জন করা সত্ত্বেও ৫৫ শতাংশ শ্রমিকের পরিবারে প্রধান থাকে পুরুষ, মাত্র ১১ শতাংশ পরিবারে নারীর প্রাধান্য রয়েছে। বাংলাদেশে মাত্র ১৩ শতাংশ পরিবারের প্রধান নারী—এ বিবেচনায় বিষয়টি মোটেও অবাক করার মতো নয় বলেও প্রতিবেদনের পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে।

0Shares

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *