বাবার চ্যালেঞ্জজয়ী পেসার সুমন খান

রুবেল হোসেনের পেস আঘাতে ৪২ রানে তিন উইকেট হারায় তামিম ইকবাল একাদশ। সেখান থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর পথ খুঁজছিলেন তারা। কিন্তু এনামুল হক বিজয়, জুনিয়র শাহাদাত হোসেন ও মোসাদ্দেক হোসেনকে সাজঘরের পথ দেখালেন সুমন খান। ২০ বছর বয়সী এই পেসার তামিম একাদশের ব্যাটিংয়ের মেরুদণ্ডই ভেঙে দিলেন। অভিজ্ঞ রুবেলের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে তুলে নিলেন তিন উইকেট। বিসিবি প্রেডিডেন্টস কাপের সুযোগটা কাজে লাগিয়ে নিজের যোগ্যতার প্রমাণ করেন সুমন খান। তাই ক্রিকেটপ্রেমীদের মনে সরল প্রশ্ন- কে এই ‘সুমন খান!’ দৈনিক মানবজমিনের স্পোর্টস রিপোর্টার ইশতিয়াক পারভেজের সঙ্গে আলাপে তিনি বলেন, তার ক্রিকেটার হওয়ার কথাই ছিল না। দেশের অন্যতম শীর্ষ বেসরকারি বিদ্যাপীঠ নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে বিবিএ পড়া শেষ করে বড় কোনো কর্পোরেট অফিসে চাকরি করবেন এটাই ছিল পরিবারের ইচ্ছা।
কিন্তু এসব ছেড়ে সুমন খান শুরু করেন বিকেএসপি মিশন। ক্রিকেটটা ছিল তার হৃদয়ে। এজন্য অবসরপ্রাপ্ত বিজিবি কর্মকর্তা পিতা সুলতান খানের সঙ্গে তার নিতে হয় তিন বছরের চ্যালেঞ্জ। তার কথোপকথনের মূল অংশ তুলে ধরা হলো-
প্রশ্ন: ক্রিকেট খেলছেন কবে থেকে?
সুমন: ছোটবেলা থেকেই ক্রিকেট খেলার প্রতি দারুণ নেশা ছিল। বাবা-মা বাড়িতে আটকে রাখতে পারতেন না। এজন্য অনেক বকাও শুনতে হয়েছে। তবে ক্রিকেট বলে খেলা হয়নি আমার ছোট বেলায়। এসএসসি’র পর মাঠ থেকেও দূরে সরে যাই। কারণ ভালো ছাত্র ছিলাম বলে পরিবারের চাপও ছিল। এইচএসসি শেষ করে নর্থ-সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই। কিন্তু মনের মধ্যে ছিল ক্রিকেট। তাই ২০১৬ তে পেসার হান্টের বিজ্ঞাপন দেখে নতুন করে সিদ্ধান্ত নেই। অংশ নেই সেখানে, আমি ২০ জনের মধ্যে জায়গা করে নিয়েছিলাম। কিন্তু ফিটনেস ও ইনজুরির কারণে আমি বাদ পড়ি। তবে থেমে থাকিনি।
প্রশ্ন: নামি বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে আপনি কীভাবে বিকেএসপিতে ভর্তি হলেন?
সুমন: পরিবারের কেউ রাজি ছিল না আমি ক্রিকেট খেলি। আমাকে এক পরিচিত জন বুদ্ধি দেয় বিকেএসপি’র ডিগ্রিতে ভর্তি হতে। তখন আমি নর্থ-সাউথে চতুর্থ সেমিস্টার শেষ করেছি। আমি বাবাকে বোঝাতে চেষ্টা করলাম। বললাম আমাকে যেন নিজের মতো করে ভবিষ্যৎ বেছে নেয়ার সুযোগ দেন। শেষ পর্যন্ত রাজি হলেন বাবা। কিন্তু তিনি ৩ বছর সময় বেঁধে দিলেন। বলেন, এরমধ্যে যদি আমি নিজেকে প্রমাণ করতে পারি ভালো নয়তো আমাকে ফিরতে হবে।
প্রশ্ন: বিকেএসপি’র এই মিশনে কতটা সফল হয়েছিলেন?
সুমন: বাবার মুখে হাসি ফোটানোটাই আমার জন্য বড় পাওয়া। এই জন্য আমাকে প্রতিটি সুযোগ কাজে লাগাতে হয়েছে। বিকেএসপি’র হয়ে প্রথম বিভাগ লীগে খেলার সুযোগ পেয়েই বল হাতে ভালো করি। সবচেয়ে বড় সুযোগ ছিল বিকেএসপি’র হয়ে ২০১৯ এ ঢাকা প্রিমিয়ার লীগে খেলা। আমি সেখানে ১০ ম্যাচে ১৫ উইকেট তুলে নেই। এরপর এইচপিতে সুযোগ হয়। সেখানে খেলেও ভালো করি। এইচপি’র হয়ে নিয়মিত খেলা হচ্ছে। বিপিএলেও খেলার সুযোগ হয়েছে।
প্রশ্ন: খুব অল্প সময়ে ‘বিকেএসপি থেকে এইচপি’- এই অভিজ্ঞতা কেমন ছিল?
সুমন: একটা সময় আমি জানতাম না অনূর্ধ্ব-১৯ বলে বিসিবির কোনো দল আছে। আমি ছোটবেলা থেকে ভাবতাম মাঠে ক্রিকেট খেললেই হয়তো কেউ দেখে দলে ডেকে সুযোগ দিবে। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। আমার পেসার হান্ট থেকে বাদ পড়ার কারণ ছিল ফিটনেস। তখন বিপ টেস্টে মাত্র ৮ তুলেছিলাম। সেখান থেকেই জেদ তৈরি হয়। এই লেভেলে ক্রিকেট খেলতে হলে ফিটনেসের কোনো বিকল্প নেই। সে দিকেই মনোযোগ দেই। এখন তো বিপ টেস্টে ১২ পর্যন্ত তুলতে পারি।
প্রশ্ন: প্রেসিডেন্ট কাপে প্রথম ম্যাচেই তিন উইকেট। গল্পটা কী?
সুমন: উইকেট খেলার উপযোগীই ছিল। ব্যাটসম্যানরা চাইলে টিকে থাকতে পারতো। আমি আসলে এত কিছু ভাবিনি। আমার মধ্যে যে চিন্তা ছিল সেটি হলো এখানে শুরুতেই কিছু করতে না পারলে হয়তো সামনে সুযোগ নাও হতে পারে। আমি চেষ্টা করেছি নিজের শক্তির দিকটা বিশেষ করে সুইংটা কাজে লাগাতে।
প্রশ্ন: আপনার বাবা এখন কী বলেন?
সুমন: তিনি ক্রিকেট খেলতে বাধা দেন না। আমাকে উৎসাহ দেন। পরিবারের একমাত্র ছেলে আমি। বড় দুই বোনের বিয়ে হয়ে গেছে। তাই বাবার স্বপ্ন ছিল আমি নর্থ-সাউথে পড়ে ভালো কোনো চাকরি করি। সেখানে ভর্তি করতেও অনেক টাকা খরচ করেছিলেন। তবে এখন আমি তাকে কিছুটা হলেও দেখাতে পেরেছি আমি ভুল পথ বেছে নেইনি। তার মুখে এখন হাসি দেখলে আমার ভালো লাগে।
প্রশ্ন: আপনার ক্রিকেটার হওয়ার এতো জেদের পেছনে অনুপ্রেরণা কে ছিল?
সুমন: আমার বাবা একজন দৌড়বিদ ছিলেন। স্বর্ণ পদকও জিতেছেন। কিন্তু আমি বাবাকে কখনো খেলতে দেখিনি। তাই তার কাছ থেকে খেলার অনুপ্রেরণাটা আসেনি। এসেছে টিভিতে ক্রিকেট দেখে। দেশের ক্রিকেটে আমার বড় অনুপ্রেরণা ও আদর্শের নাম মাশরাফি ভাই। যদিও তার সঙ্গে কখনো বোলিং নিয়ে কথা বলার সুযোগ হয়নি। সত্যি কথা বলতে কী টাইগার ক্রিকেটাররাই আমার বড় অনুপ্রেরণা ছিল ক্রিকেটার হওয়ার পেছনে।
প্রশ্ন: লক্ষ্য কি?
সুমন: দেখেন আমি আগেই বলেছি যে আমি জানতাম না বাংলাদেশ ক্রিকেটে এতগুলো ধাপ পেরিয়ে আসতে হয়। বিকেএসপিতে যাওয়ার পর পথ ধরে এগিয়ে যাচ্ছি। লক্ষ্য একটাই ভালো কিছু করে নিজের যোগ্যতার প্রমাণ করা। এরপর আশা করি আরো কিছু পথ আমার জন্য হয়তো উন্মুক্ত হবে। তবে এজন্য বল হাতে ভালো করাই একমাত্র উপায়।

0Shares

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *