প্যানডেমিকে টেলিভিশন চ্যানেলগুলো আরো সংকটে পড়বে

খ ম হারূন দেশের টেলিভিশন মিডিয়ায় একজন পুরোধা ব্যক্তিত্ব। কর্মজীবনে বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ছিলেন। ১৯৮০ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ টেলিভিশনের বেশ কয়েকটি পদে দায়িত্ব পালন করেছেন। ১৯৮০ সালে তিনি বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রযোজক হিসেবে যোগদান করেন, ২০১০ সালে উপমহাপরিচালক পদ থেকে অবসর গ্রহণ করেন। এর মাঝে তিনি অসংখ্য টেলিভিশন নাটক ও গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠান নির্মাণ করেছেন। বর্তমানে তিনি পাঠশালা সাউথ এশিয়ান মিডিয়া ইনস্টিটিউটে চলচ্চিত্র ও টেলিভিশন বিভাগের প্রধান হিসেবে কর্মরত। এর আগে তিনি আরটিভির প্রতিষ্ঠাতা নির্বাহী পরিচালক ও অনুষ্ঠানপ্রধান এবং এসএ টিভির উপদেষ্টা (অনুষ্ঠান) ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবেও দায়িত্ব পালন করছেন। সম্প্রতি তিনি টকিজের মুখোমুখি হয়েছিলেন। কথা বলেছেন টিভি মিডিয়ার বিভিন্ন বিষয় নিয়ে। আলাপ করেছেন রাইসা জান্নাত

হোম কোয়ারেন্টিনের সময়টা কীভাবে কাটাচ্ছেন?

এখন বাসায় আছি। কিছু বিষয় ঠিক করে নিয়েছি। সকালে উঠে বই পড়া, ভালো ছবি দেখা, কথা বলা। এছাড়া কিছু আন্তর্জাতিক ও দেশের বিভিন্ন অনলাইন প্ল্যাটফর্মগুলোতে অংশগ্রহণ করছি। এভাবেই সময় কেটে যাচ্ছে।

আপনি দীর্ঘ সময় ধরে টিভি মিডিয়ার সঙ্গে যুক্ত। আপনি যে সময় কাজ শুরু করেছিলেন তখনকার এবং এখনকার সময়ে টিভি মিডিয়ার ক্ষেত্রে বড় ধরনের কী কী পরিবর্তন চোখে পড়ে?

আমি বাংলাদেশ টেলিভিশনে যোগদান করি ১৯৮০ সালে। বিটিভিতে থাকাকালীন আমরা অত্যন্ত ভালো একটা পরিবেশে কাজ করার সুযোগ পেয়েছি। সে সময় আমাদের সিনিয়র হিসেবে ছিলেন মুস্তাফা মনোয়ার, আব্দুল্লাহ আল-মামুন, মোস্তফা কামাল সৈয়দ, আতিকুল হক চৌধুরী, মোস্তাফিজুর রহমানসহ আরো অনেকেই। তাদের হাত ধরেই কাজ শেখা। পরিবেশটাও ছিল অসাধারণ। তখন তো একটা মাত্রই চ্যানেল ছিল এবং দেশের সব গুণীজনের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু ছিল বাংলাদেশ টেলিভিশন। এরপর বিচ্ছিন্নভাবে এটিএন বাংলা, চ্যানেল আইসহ আরো কয়েকটি স্যাটেলাইট টেলিভিশন আসে। তখন সরকারের কাছ থেকে অনুমতি নেয়ার প্রয়োজন হতো না। ১৯৯৯ সালে আসে একুশে টেলিভিশন। এটা ছিল সরকার অনুমোদিত প্রথম প্রাইভেট টেলিভিশন চ্যানেল। দেশের প্রাইভেট সেক্টরে সবচেয়ে সুসংগঠিত ও সুপরিকল্পিত চ্যানেল। কার্যপদ্ধতি ছিল উচ্চপেশাদার মানসম্পন্ন। সংবাদের ক্ষেত্রে একুশে টেলিভিশন নতুন মাত্রা যোগ করেছিল। আধুনিক টেলিভিশন রিপোর্টিংয়ের শুরু হয় এ চ্যানেল থেকেই। এরপর এনটিভি, আরটিভি, চ্যানেল ওয়ান, বাংলাভিশন, বৈশাখীসহ একসঙ্গে বেশ কয়েকটি টেলিভিশনের অনুমোদন দেয়া হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে আরো বেশ কয়েকটি চ্যানেলের অনুমোদন দেয়া হয়। তবে দুঃখের বিষয়, সবচেয়ে সুসংগঠিত একুশে টেলিভিশনের সম্প্রচার বন্ধ হয়ে যায়। কয়েক বছর পর চ্যানেলটি আবার সম্প্রচারে ফিরে এলেও আগের মান আর ধরে রাখতে পারেনি।

বাংলাদেশ টেলিভিশনকে অনুষ্ঠানের দিক থেকে এখনো কোনো চ্যানেল স্পর্শ করতে পারেনি এবং তা সম্ভবও না। কিন্তু বিটিভির সংবাদ ছিল সবসময় সরকার নিয়ন্ত্রিত। সেজন্য বিটিভির সংবাদ কখনো তেমন জনপ্রিয়তা অর্জন করতে পারেনি। যদিও অনেক সংবাদ উপস্থাপক ও সংবাদ প্রযোজক বিটিভির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।

 বিটিভির ধারাবাহিক নাটক ‘শঙ্কিত পদযাত্রা’র সেটে পরিচালক খ ম হারূনের সঙ্গে মাহফুজ আহমেদ ও ফাইজুল ইসলাম, ১৯৯২

অনলাইন প্ল্যাটফর্ম আসার ফলে টেলিভিশন সংকটে পড়েছে। এখন আবার যুক্ত হয়েছে কভিড-১৯। তাহলে টিভি মিডিয়ার ভবিষ্যত্টা আসলে কী?

টেলিভিশন তো সংকটের মধ্যেই আছে। আগে যা আয় করত এখন তার অর্ধেকও করে না। আগে প্রয়োজনের তুলনায় অতিরিক্ত লোকবল ছিল। এখন লোকবল ছাঁটাই চলছে। এটা করতে গিয়ে আরেকটি সংকট তৈরি হচ্ছে। কেবল দেশে নয়, সারা পৃথিবীতে টেলিভিশনের দর্শক কমে গেছে। এজন্য প্রধান টেলিভিশন চ্যানেলগুলো ট্র্যাডিশনাল সম্প্রচারের ভেতরে না থেকে অনলাইন সম্প্রচারেও যুক্ত হচ্ছে। এখনকার যুগটা হচ্ছে অনলাইন প্ল্যাটফর্ম ও সোস্যাল মিডিয়ার। বিজ্ঞাপনদাতা প্রতিষ্ঠানগুলো এটা ভালোভাবেই বুঝতে পেরেছে। এসব জায়গাতেও তারা বিজ্ঞাপন দিচ্ছে। ফলে আগে সাত-আটটি চ্যানেলের ভেতরে যে বিজ্ঞাপনের টাকা বরাদ্দ থাকত, সেটা এখন ৩৬টি চ্যানেলের মাঝে ভাগ হয়ে গেছে। বর্তমানে এ প্যানডেমিকের সময়ে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলো যারা বিজ্ঞাপন দিত তাদের আয়ও কমে গেছে। তারা আগের মতো বিজ্ঞাপন এখন আর দিতে পারবে না। ফলে টেলিভিশনগুলো আরো সংকটে পড়বে। এর মাঝে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশকিছু সাইট যুক্ত হয়েছে যেমন—নেটফ্লিক্স, হইচই, বায়োস্কোপ, আইফ্লিক্স ইত্যাদি। সুতরাং টেলিভিশন দর্শকদের একটা বড় অংশ এসব সাইটে তাদের পছন্দমতো চলচ্চিত্র, নাটক, ওয়েব সিরিজ, তথ্যচিত্র দেখে।

আপনি নির্মাণের সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন। এখনকার নাটকের মান, গল্প নিয়ে নানা অভিযোগ। এর কারণ হিসেবে চ্যানেলগুলোর স্বল্প বাজেটকে দায়ী করা হয়। এ বিষয়ে আপনার কী মত?

নাটকের আকালের সঙ্গে টেলিভিশনের আকালের বিষয়টি যুক্ত। একুশে টিভি, এনটিভি, আরটিভি প্রথমদিকে নাটক নির্মাণে বিটিভির পদ্ধতিটা অনুসরণ করত। আমি তো বিটিভির একজন অনুষ্ঠান নির্মাতাই ছিলাম। অনেক নাটক নির্মাণ করেছি, যেগুলো এখনো মানুষ মনে রেখেছে। এসব নাটকের প্রতিটা শট দেখলেই বোঝা যায়, কত আন্তরিকতা ও পেশাদারিত্ব ছিল। প্রতিটি নাটক তৈরির পেছনে আমাদের অনেক দিনের পরিশ্রম ও পরিকল্পনা জড়িত ছিল। বিটিভির শিল্প নির্দেশনা বিভাগ অত্যন্ত সমৃদ্ধশালী, যেখানে বাংলাদেশের অনেক গুণী ডিজাইনাররা কাজ করেন। নাটকের কস্টিউমও নিজেরা তৈরি করে। কিন্তু প্রাইভেট টেলিভিশনগুলোয় এগুলো নিয়ে কোনো চিন্তাভাবনা নেই। নাটকের চিত্রনাট্য আগে থেকে লেখা হয় না। স্বল্প বাজেটসহ নানা ধরনের ভাঁড়ামি, সস্তা সংলাপ এখন নাটকের মধ্যে ঢুকে গেছে।

   বিটিভিতে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ধারাবাহিক নাটক ‘শুকতারা’র শুটিং সেটে

মানসম্মত নাটক তৈরি না হওয়ার পেছনে বাজেটটাই কি মূল সমস্যা?

না, বাজেট সমস্যা না। এটা হলো খুব কৌশলে পেশাদার নির্মাতাদের এখান থেকে সরিয়ে দেয়া। এটা এক ধরনের ষড়যন্ত্র। কারণ টেলিভিশন যখন অনুষ্ঠাননির্ভর থাকে না বা অনুষ্ঠান সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেয়ার মতো কোনো পেশাদার ব্যক্তি থাকেন না, তখন চ্যানেলগুলো ভুল সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়। এ কারণে আজকের টেলিভশন চ্যানেলগুলোর এ করুণ অবস্থা।

টিভি চ্যানেলগুলো মানহীন কনটেন্ট দেখাচ্ছে, নির্মাতারা তা তৈরিও করছে। বিষয়টি সম্পর্কে আপনি কী মনে করেন?

এখন টেলিভিশনগুলোর কাজের নিয়ন্ত্রণ কাদের হাতে সেটা দেখতে হবে। যাদের নিয়ন্ত্রণে তারা তো মানহীন কনটেন্টই চায়। প্রথমদিকে বেসরকারি চ্যানেলগুলোতে যখন পেশাদার লোকজন ছিল, তখন তো এ ধরনের মানহীন অনুষ্ঠান ছিল না।

0Shares

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *