নিজ দেশেও যেন পরবাসী ডা. মুরাদ!

নব্বই দশকে বিটিভিতে প্রচারিত হুমায়ূন আহমেদের কালজয়ী ‘কোথাও কেউ নেই’ নাটকের কথা সবার মনে আছে নিশ্চই। জীবনের বাকে নানান ঘাত-প্রতিঘাত শেষে পরিবারসহ প্রিয়ভাজন বাকের ভাইকে হারিয়ে নিঃসঙ্গ মুনার হেটে চলার ভিডিও ফুটেজটি দেখলে যে কারোরই মন খারাপ হতে বাধ্য। ‘কোথাও কেউ নেই’ নামের স্বার্থকতা হয়তো প্রমাণ হয় নাটকের শেষাংশের এই দৃশ্যটি দেখলে।

প্রেক্ষাপট পুরোপুরি ভিন্ন হলেও পরিস্থিতির বিচারে মুনার মতো হঠাৎই নিসঃঙ্গ বনে গেছেন বহুল আলোচিত সাবেক প্রতিমন্ত্রী ডা. মুরাদ হাসান। ৭ ডিসেম্বর পদত্যাগ করার পর সপ্তাহ না ঘুরতেই যেনো জীবনের ৩৬০ ডিগ্রি ঘুরে গেছে মুরাদ হাসানের।

বিতর্কের মুখে তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করা ডা. মুরাদ হাসানের পাশে বন্ধু ও স্বজন কেউ নেই। কয়েকদিন আগেও দুর্দান্ত প্রতাপশালী ছিলেন এই প্রতিমন্ত্রী। অথচ এখন জন্মভূমিতেও তিনি যেন পরবাসী! নিজ হাতে সাজানো বাসাতেও ঠাঁই হয়নি। গ্রেপ্তার এড়াতে অনেকটাই আত্মগোপনে।

কদিন আগেও তিনি ছিলেন অনেকের প্রিয়ভাজন। আশপাশে বন্ধু ও স্বজনের অভাব ছিল না। তার সঙ্গে একটু দেখা করা, দুই মিনিট কথা বলা ও আড্ডা দিতে পারলেও অনেকে নিজেকে ধন্য মনে করতেন।

মুরাদ হাসানের সঙ্গে আড্ডা শেষে বেরিয়েই তারা হয়তো বলতেন- এই তো প্রভাবশালী প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে এলাম! যুক্তি-তর্কে তিনি ভীষণ পটু। নানা বিশেষণে তাকে বিশেষায়িত করে প্রশংসায় ভাসাতেন।
[১] জীবনের জন্য বাঁচতে হবে, তাই বাধ্য হয়ে দোকানপাট খুলেছি, বলছেন ব্যবসায়ীরা ≣ অতিরিক্ত যাত্রী-মাঝির ভুলেই ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ট্রলারডুবি: তদন্ত কমিটি ≣ নাশকশা জালিয়াতি: দুদকের মামলায় রাজউকের সাকেব চেয়ারম্যান হুমায়ুন খাদেম’সহ চার জনের বিরুদ্ধ অভিযোগ গঠন, বিচার শুরু

মুরাদ হাসান চিকিৎসক হওয়ায় তাকে নিয়ে চিকিৎসক মহলের অনেকেই বেশ গলা উঁচিয়েই কথা বলতেন। অথচ আজ তার পাশে কেউ নেই। বিপদে নিজের ছায়াও সঙ্গে থাকে না- প্রবাদটি যেন তার ক্ষেত্রে পুরোপুরি বাস্তবে রূপ নিয়েছে।

বিভিন্ন সভা-সমাবেশে নানান ইস্যুতে বিতর্কিত বক্তব্য দিয়ে অনেকদিন ধরেই আলোচনায় ছিলেন ডা. মুরাদ হাসান। তবে রাষ্ট্রধর্ম ‘ইসলাম’ বাদ দেওয়া ও ৭২’র সংবিধানে ফিরে যাওয়ার দাবি তোলার পর সমালোচনার মুখে পড়ে তিনি।

‘নাহিদ রেইনস’ নামে এক তরুণের ফেসবুক লাইভ অনুষ্ঠানে যুক্ত হয়ে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের মেয়েকে নিয়ে অশালীন মন্তব্য করেন তিনি। ওই অনুষ্ঠানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী ও ছাত্রলীগ নেত্রীদের নিয়ে বিভিন্ন আপত্তিকর মন্তব্য করেন মুরাদ।

এরপরই ঢাকাই সিনেমার একজন নায়িকার সঙ্গে তার ফোনালাপ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ফাঁস হয়। সেখানে মাহির সঙ্গে অশ্লীল ভাষায় কথা বলেন তিনি। এমনকি মাহিকে ধর্ষণ এবং উঠিয়ে আনার হুমকি দেন। তখন ফোনে চিত্রনায়ক ইমনকে প্রতিমন্ত্রী বলছিলেন, ঘাড় ধরে যেন মাহিকে তার কাছে নিয়ে যান।

সেই অডিও ভাইরাল হলে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েন মুরাদ হাসান। পরে তাকে ৭ ডিসেম্বরের মধ্যে মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগের নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা মেনে ৭ ডিসেম্বর মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করেন মুরাদ হাসান। ওইদিন রাতে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ তার পদত্যাগপত্র গ্রহণ করেন।

একই দিন সন্ধ্যায় জামালপুর জেলা আওয়ামী লীগের স্বাস্থ্য ও জনসংখ্যাবিষয়ক সম্পাদকের পদ থেকেও মুরাদ হাসানকে অব্যাহতি দেওয়ার সুপারিশ করে জেলা আওয়ামী লীগ। ওই সুপারিশ কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদে পাঠানো হয়।

এসব ঘটনার পর ক্ষমা চান মুরাদ হাসান। তিনি ফেসবুকে লিখেন, ‘আমি যদি কোনো ভুল করে থাকি অথবা আমার কথায় মা-বোনদের মনে কষ্ট দিয়ে থাকি তাহলে ক্ষমা করে দেবেন।’

তবে কিছুতেই যেন কিছুই হচ্ছিল না। দুঃখ ও অভিমানে একপর্যায়ে সুদূর কানাডা পাড়ি জমিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু কানাডিয়ান সরকারও তাকে সেদেশে প্রবেশের অনুমতি দেয়নি। সম্প্রতি বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের ব্যাপারে কানাডায় বসবাস করা বাংলাদেশিরা তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন তথ্য-প্রমাণসহ দেশটির সরকারের কাছে অভিযোগ করেছেন।

ফলে তাকে সেদেশেও প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি। ফিরতি ফ্লাইটে তাকে দেশে পাঠানো হয়। দুবাই হয়ে আসার পথে তিনি অন্য কোনো দেশের ভিসার জন্য চেষ্টা করেও পাননি। শেষ পর্যন্ত তাকে ফিরতে হয়েছে দেশেই।

প্রতিমন্ত্রী থাকাকালে বিদেশে যাওয়া ও আসার সময় ভিআইপি প্রটোকল ও ভিআইপি লাউঞ্জে ঘনিষ্টজনদের সঙ্গে আড্ডা দিয়ে বিমানে উঠতেন তিনি। ফেরার পথেও প্রটোকল নিয়েই বিমানবন্দর থেকে বাসায় যেতেন মুরাদ। তবে আজকের চিত্র ভিন্ন। সাবেক প্রতিমন্ত্রী ও বর্তমান সংসদ সদস্য হয়েও সাধারণ যাত্রীর মতোই লাইনে দাঁড়িয়ে ইমিগ্রেশনসহ বিভিন্ন আনুষ্ঠানিকতা সারলেন মুরাদ।

বিমানবন্দর সূত্র জানায়, খুব দ্রুততম সময়ে আনুষ্ঠানিকতা শেষ করেন মুরাদ হাসান। আন্তজার্তিক বিমানবন্দর থেকে অভ্যন্তরীণ বিমানবন্দরের টার্মিনাল হয়ে গাড়িতে করে চুপিসারে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ছাড়েন তিনি।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক চিকিৎসক নেতা বলেন, ‘মুরাদ হাসানের কারণে পুরো চিকিৎসক সমাজের প্রতি মানুষের বিরূপ ধারণা তৈরি হচ্ছে। চিকিৎসকদের মধ্যে অনেকেই তার ঘনিষ্ঠজন থাকলেও এখন তারা কেউ পাশে নেই। নিজ কর্মকাণ্ডের কারণে তিনি সব খুঁইয়েছেন।’

জানা গেছে, মুরাদ কয়েকমাস আগে কানাডা ঘুরতে গিয়েছিলেন। ভিসা থাকায় ভেবেছিলেন খুব সহজেই তিনি কানাডা প্রবেশ করতে পারবেন। তবে বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের কারণে তিনি তা পারেননি।

কানাডা থেকে দুবাই হয়ে তাকে দেশে ফিরতে হয়। দেশে ফিরে বিমানবন্দর থেকে নামার পর তিনি রীতিমতো ‘হাওয়া’ হয়ে গেছেন। তার ঘনিষ্ঠজনরাও তার কোনো খোঁজ-খবর পাচ্ছেন না বলে জানা গেছে।

0Shares

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *