দুর্নীতিতে ডুবছে শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর

সরকারি অর্থে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নির্মাণ সংস্থা ‘শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরে’ (ইইডি) চলছে নানান অনিয়ম। একশ্রেণির প্রকৌশলী এই প্রতিষ্ঠানটিকে টাকা কামানোর মেশিনে পরিণত করেছেন। ঠিকাদারদের সঙ্গে যোগসাজশে নিম্নমানের উপকরণে নির্মিত হচ্ছে ভবন। অবস্থা এমন যে, উদ্বোধনের আগেই কোনো কোনো ভবন হেলে পড়ছে। কোথাও বছর না যেতেই খসে পড়ছে প্রতিষ্ঠানের পলেস্তারা।

রহস্যজনক কারণে একই ব্যক্তির কব্জায় ছিল ৩ ডজনের বেশি প্রকল্প। এনিয়ে হইচইয়ের পর এখনও তিনি ১১টি প্রকল্পের পরিচালক (পিডি)। সম্প্রতি দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) এ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অবশ্য মামলা হয়েছে। ওই মামলায় তারই শাখার অন্য তিন প্রকৌশলীকে সাক্ষী করা হয়েছে। এছাড়া আরও এক শীর্ষ পর্যায়ের প্রকৌশলীও মামলার আসামি। যুগান্তরের অনুসন্ধানে এসব তথ্য জানা গেছে।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, মূলত প্রতিষ্ঠানটির ভেতরে একটি চক্র আছে। বছরের পর বছর তারা প্রধান কার্যালয়ে প্রায় ঘাঁটি গেড়ে বসে আছে। যে কারণে দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়া সহজ হয়েছে। তারা বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছেন। ইইডিতে চলমান বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি সম্পর্কে মন্ত্রণালয় অবগত। যে কারণে ৪ নভেম্বর এ সংস্থার এক অনুষ্ঠানে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি প্রকৌশলীদের সততা, দক্ষতা ও স্বচ্ছতার সঙ্গে দায়িত্ব পালনের আহ্বান জানান।

অন্যদিকে ইইডির দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করার পরও যথাযথ প্রতিকার না পেয়ে ভুক্তভোগীদের কেউ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, কেউবা মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ কিংবা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে অভিযোগ দায়ের করেছেন। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পাওয়া আর্থিক ও নির্মাণ দুর্নীতির অভিযোগ তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। ফলে এই মুহূর্তে ৭টি তদন্ত চলমান।

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে প্রধান প্রকৌশলী (দায়িত্বপ্রাপ্ত) মো. দেলোয়ার হোসেন মজুমদার যুগান্তরকে বলেন, ইইডিতে কোনো চক্র আছে বলে তার জানা নেই। কয়েকজনের হাতে বেশকিছু প্রকল্প আছে। সেগুলো তিনি দায়িত্বে আসার আগেই বণ্টন হয়েছে। কোন প্রক্রিয়ায় কেন কিছু লোকের হাতে বেশিরভাগ প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে, তা তিনি জানেন না। অনিয়ম-দুর্নীতির কোনো অভিযোগ তদন্তাধীন আছে কিনা-সেটা তার জানা নেই। তবে তিনি দায়িত্বে আসার পরে দুদক এক নির্বাহী প্রকৌশলীকে ডেকেছে। সঙ্গে একই ডেস্কের কয়েকজনকে সাক্ষী হিসাবে ডেকেছে।

জানা গেছে, সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ থাকায় পদোন্নতিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয় সতর্কতা অবলম্বন করছে। তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী পদে সম্প্রতি পদোন্নতির উদ্যোগ নেওয়া হয়। এতে প্রথমে ৮ জনের নাম থাকলেও ৪ জনকে বাদ দেওয়া হয়। বাকি ৪ জনের বিরুদ্ধে দুর্নীতির দায়ে মামলা আছে কিনা তা জানতে দুদকে চিঠি পাঠানো হচ্ছে। এছাড়া দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রধান প্রকৌশলীর ব্যাপারেও একই কারণে খোঁজ নিচ্ছে মন্ত্রণালয়। তবে সূত্র জানায়, ৪ জনের যে তালিকা করা হয়েছে সেখানে দুদকের মামলার এক আসামিও আছেন।

এছাড়া অনিয়মের অভিযোগে ইইডির কিছু বিষয়ে ক্ষমতা মন্ত্রণালয়ে নেওয়া হয়েছে। এরমধ্যে অন্যতম হচ্ছে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জন্য নতুন ভবন নির্মাণ আর সংস্কারের তালিকা তৈরির কাজ। এটি এখন থেকে মন্ত্রণালয় করবে। এছাড়া প্রধান প্রকৌশলীর কিছু বিষয়ের ক্ষমতা তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলীদের মাঝে বিকেন্দ্রীকরণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সংস্থাটির ‘দুর্নীতিবাজ’ প্রকৌশলীরা নির্দিষ্ট হারে ঠিকাদারদের কাছ থেকে যাতে অর্থ নিতে না পারেন সেই রাস্তাও খোঁজা হচ্ছে।

তবে এতকিছুর পরও দুর্নীতিবাজ বা বেশিরভাগ কাজ কুক্ষিগত করে রাখা প্রকৌশলীরা কীভাবে বহাল আছেন সেই প্রশ্ন সবার মুখে। এজন্য মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ ব্যক্তিদের ‘এলাকাইজম’কে কেউ কেউ চিহ্নিত করেছেন।

কয়েকজনের হাতে কাজ কুক্ষিগত : শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভবন নির্মাণে ইইডির নিজস্ব কিছু প্রকল্প আছে। এছাড়া সরকারের সংস্কার এবং রক্ষণাবেক্ষণ খাতের ব্যয় এ প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে হয়ে থাকে। এর বাইরে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি), বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) এবং মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদপ্তরের (ডিএমই) বিভিন্ন প্রকল্পের অধীনে ভবন নির্মাণসংক্রান্ত কাজও সম্পন্ন হয়ে থাকে ইইডির মাধ্যমে।

এক হিসাবে দেখা গেছে, ইইডি বর্তমানে যেসব পূর্ত কাজ করছে, তার মধ্যে প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ের ২৫টি প্রকল্পের কাজ ৫ জনের কব্জায়। কিন্তু আবুল হাশেম সরদার নামে একজনের কাছেই এক সময়ে ৩৯টি প্রকল্প ছিল। বর্তমানে ১১টি প্রকল্পের পিডি তিনি। এগুলোর আর্থিক বাজেট ৩৫৯১ কোটি টাকার বেশি। সম্প্রতি তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আমলে নিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তলব করেছে। ২৭ অক্টোবর দুদক থেকে প্রধান প্রকৌশলীর মাধ্যমে ওই প্রকৌশলীকে (হাশেম) চিঠি দেওয়া হয়েছে। তাতে উল্লেখ করা হয়, তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে প্রায় ২শ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জন এবং বিদেশে পাচারের অভিযোগ আছে। এই অভিযোগ সুষ্ঠুভাবে অনুসন্ধানের স্বার্থে আবুল হাশেম সরদারের বক্তব্য শোনা ও গ্রহণ করা দরকার।

এ বিষয়ে কথা বলার জন্য গত ২ সপ্তাহে কয়েকবার আবুল হাশেম সরদারের দপ্তরে গিয়েও তাকে পাওয়া যায়নি। তবে মামলার বিষয়টি নিশ্চিত করে প্রধান প্রকৌশলী যুগান্তরকে বলেন, চিঠিতে মোট চারজনের বক্তব্য নেওয়ার কথা আছে। তাদের মধ্যে একই ডেস্কের অন্য তিন সহকারী ও উপসহকারী প্রকৌশলীকে সাক্ষী করা হয়েছে। অপরজনের নামে মামলা হয়েছে।

এছাড়া মাহাবুবর রহমান ও মো. রফিকুল ইসলাম নামে আরও দুই প্রকৌশলীর হাতে একাধিক প্রকল্প আছে। তাদের মধ্যে মাহাবুবর রহমান ৪টি এবং রফিকুল ইসলাম ২টি প্রকল্পের দায়িত্বে আছেন। তাদের হাতে যথাক্রমে ৫ হাজার ৯০৯ এবং ৫ হাজার ৬২০ কোটি টাকার কাজ বাস্তবায়িত হচ্ছে। সব মিলিয়ে পাঁচ কর্মকর্তার হাতে প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকার কাজ। নিয়ম ভেঙে বিদায়ি প্রধান প্রকৌশলী শাহ্ নইমুল কাদেরও ১০ হাজার ৬০০ কোটি টাকার কাজ নিজের হাতে রেখেছিলেন। এছাড়া আরেকজনের হাতে আছে ২৫ হাজার কোটি টাকার প্রকল্পের কাজ।

এসব বিষয় নিশ্চিত করে ইইডির পরিচালক (প্রশাসন) রাহেদ হোসেন যুগান্তরকে বলেন, নিয়ম অনুযায়ী সব নির্বাহী এবং তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলীই পিডি হওয়ার যোগ্য। বর্তমানে এ ধরনের কর্মকর্তা আছেন ৪৮ জন। যেহেতু কয়েকজনের হাতে প্রকল্পগুলো ছিল, তাই তা যৌক্তিকভাবে বণ্টনের জন্য আরও ৫ জনকে পিডি করার প্রস্তাব সম্প্রতি মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত অনুমোদিত ফাইল ফেরত আসেনি।

পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের ২০২২ ও ২০১৬ সালের নির্দেশিকা ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী এক কর্মকর্তা একটির বেশি প্রকল্পের দায়িত্বে থাকার নয়।

পদক্ষেপও আটকে গেছে : ১১ অক্টোবর প্রকল্পগুলো পুনঃবণ্টনের প্রস্তাবে যাদের নাম রাখা হয়েছে, তাদের মধ্যে আছে- আ ট ম মারুফ আল ফারুকি ও আফরোজা বেগম নামে দুই তত্ত্বাবধায়ক এবং জয়নাল আবেদীন, মীর মুয়াজ্জেম হোসেন, মাহাবুবুর রহমান, সুমী দেবী এবং এসএম সাফিন হাসান। তাদের মধ্যে ৭টি প্রকল্প বণ্টনের কথা উল্লেখ আছে। তবে এদের মধ্যে জয়নাল আবেদীনের নামে দুদকে মামলা আছে। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন সংস্থাটির পরিচালক রাহেদ হোসেন।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পিডি নিয়োগসংক্রান্ত দিকটি দেখে পরিকল্পনা অধিশাখা। ওই শাখার অতিরিক্ত সচিব ড. আমজাদ হোসেনের কাছে জানতে চাইলে ‘এসব বিষয়ে আমি কিছু জানি না’ বলে ফোনের লাইন কেটে দেন।

৭টি তদন্ত চলছে : সূত্র জানায়, ইইডিতে এই মূহূর্তে ৭টি তদন্ত চলছে। এরমধ্যে একটি হচ্ছে পটুয়াখালীর কলাপাড়ার ধানখালী এমইউ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ৫ তলা সাইক্লোন শেল্টার ভবনের কাজে অনিয়ম ও সেখানকার এক সহকারী প্রধান শিক্ষিকার দুর্নীতি। গত বছরের নভেম্বরে এই অভিযোগটি পড়ে। এছাড়া গত বছরের অক্টোবরে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে নীলফামারীর এক সহকারী প্রকৌশলীর বিরুদ্ধে একইভাবে দুর্নীতির অভিযোগ করা হয়।

ফেব্রুয়ারিতে দরপত্রসংক্রান্ত বিভিন্ন দুর্নীতি আর অনিয়মের অভিযোগ আসে গোপালগঞ্জের এক প্রকৌশলীর বিরুদ্ধে। কক্সবাজার জোনের এক উপ-সহকারী প্রকৌশলীর বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ আসে এপ্রিলে।

শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, প্রতিটি ঘটনায় ১৫ কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন এবং তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেওয়ার তথ্য জানাতে চিঠি দেওয়া হয়েছিল ইইডিতে। কিন্তু দীর্ঘদিনেও ইইডি থেকে সাড়া মেলেনি। মূলত প্রতিষ্ঠানটি সময়ক্ষেপণের মাধ্যমে দোষীদের পার করে দেওয়ার অপচেষ্টা করছে বলে অভিযোগ আসছে। এছাড়া নিয়োগসংক্রান্ত পরীক্ষা নিয়েও অনিয়মের অভিযোগ আছে। এমন একটি অভিযোগে উচ্চ আদালতে রিট হয়েছে বলে জানা গেছে।

0Shares

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *