তিনি ছিলেন এক সহজাত শিল্পী

ঘাতক নভেল করোনাভাইরাসের কাছে হার মেনে ১৪ সেপ্টেম্বর পৃথিবী থেকে বিদায় নিলেন দেশের খ্যাতিমান অভিনয়শিল্পী সাদেক বাচ্চু (৬৬)। ডাক বিভাগের সাবেক কর্মকর্তা সাদেক হোসেন বাচ্চু ১৯৮৫ সালে চলচ্চিত্র জগতে পা রাখেন। ‘রামের সুমতি’ ছবির মাধ্যমে যাত্রার পর বহু জনপ্রিয় চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন তিনি। নব্বই দশকের প্রখ্যাত নির্মাতা এহতেশামের ‘চাঁদনি’ চলচ্চিত্রে অভিনয়ের মধ্য দিয়ে জনপ্রিয়তা লাভ করেন এ গুণী অভিনেতা।

খ্যাতিমান অভিনেতা সাদেক বাচ্চু চলচ্চিত্র ছাড়াও কাজ করেছেন মঞ্চ ও টেলিভিশনে। কয়েক দশক ধরে মঞ্চ, টেলিভিশন ও চলচ্চিত্র—প্রতিটি মাধ্যমেই রেখেছেন তার প্রতিভার স্বাক্ষর। বিটিভির আলোচিত গ্রন্থিকগণ কহে, জ্বোনাকি জ্বলে, সোজন বাদিয়ার ঘাট, পূর্ব রাত্রি পূর্ব দিন, নকশি কাঁথার মাঠ—নাটকগুলোয় অভিনয় করে বেশ আলোচিত ও প্রশংসিত হন তিনি।

৫০ বছরের অভিনয় জীবনের শুরুতে মঞ্চ নাটকে অভিনয় করতেন। মতিঝিল থিয়েটারের প্রতিষ্ঠাতা ও দলের সভাপতি ছিলেন। বেতারে এক সময় প্রচুর নাটক করেছেন। বেতারের ‘খেলাঘর’ তার আলোচিত একটি নাটক। ১৯৭৪ সালে ‘প্রথম অঙ্গীকার’ নাটকের মধ্য দিয়ে প্রথমবারের মতো টেলিভিশনে দেখা যায় তাকে।

চলচ্চিত্র ক্যারিয়ারে অভিনেতা সাদেক বাচ্চু তার জীবদ্দশায় অসংখ্য ব্যবসাসফল ছবি উপহার দিয়েছেন দর্শকদের। এ তালিকায় রয়েছে রামের সুমতি, সুজন সখি, ভালোবাসা জিন্দাবাদ, কোটি টাকার কাবিন, পূর্ণদৈর্ঘ্য প্রেম কাহিনী, পিতা-মাতার আমানত, মরণ কামড়, আনন্দ অশ্রুসহ অসংখ্য চলচ্চিত্র। চলচ্চিত্র তিনি মূলত খলচরিত্রের জন্য দর্শকদের কাছে আলাদা পরিচিতি পেয়েছিলেন। ২০১৮ সালে ‘একটি সিনেমার গল্প’ চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্য খলচরিত্রে সেরা অভিনয়শিল্পীর ‘জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার’ লাভ করেন।

চলচ্চিত্রের অভিনয় জীবনে সাদেক বাচ্চু বেশি কাজ করেছেন পরিচালক এফআই মানিকের সঙ্গে। বরেণ্য অভিনেতার প্রয়াণে যোগাযোগ করা হয় তার সঙ্গে। প্রিয় মানুষকে হারিয়ে প্রবীণ এ নির্মাতা যেন স্মৃতিবিহ্বল হয়ে পড়েছেন। স্মৃতির পাতা হাতড়িয়ে সাদেক বাচ্চুকে নিয়ে নানা স্মৃতিচারণ করলেন। বললেন, ‘‘তিনি (সাদেক বাচ্চু) দায়িত্ব নিয়ে কাজ করতেন। বাচ্চু ভাই বলতেন, ‘এভাবে আর কতদিন ইন্ডাস্ট্রি শূন্য হয়ে থাকবে? ভালো ভালো লেখকরা লিখছেন না, প্রডাক্ট তৈরি করছেন না।’ চলচ্চিত্র নিয়ে একটা মানুষ আমাকে সবসময় প্রেরণা দিতেন, তিনি সাদেক বাচ্চু। বাচ্চু ভাই অত্যন্ত প্রিয় মানুষ ছিলেন। শিল্পী বলতে যা বোঝায় তিনি তা-ই ছিলেন। সব ধরনের চরিত্রে অভিনয় করতে পারতেন। অভিনয়ের ওপর অসাধারণ নিয়ন্ত্রণ ছিল তার। সহজাত এক শিল্পী ছিলেন তিনি।’’

দেশীয় চলচ্চিত্র নির্মাতা এফআই মানিক নিজের বেশির ভাগ ছবিতে কাস্ট করেছেন সাদেক বাচ্চুকে। তার সঙ্গে সাদেক বাচ্চুর ভালো ‘কেমেস্ট্রি’ ছিল। ‘বাচ্চু ভাই আমার অধিকাংশ ছবির আর্টিস্ট। আমরা একসঙ্গে অনেক কাজ করেছি। তিনি সবসময় তার সেরাটা ঢেলে দেয়ার চেষ্টা করতেন। আমার ৫৩টা ছবি রিলিজ হয়েছে, এর মধ্যে বেশির ভাগ ছবিতেই তিনি কাজ করেছেন’—এফআই মানিক বলেন।

আলাপের এক পর্যায়ে গুণী অভিনেতা সাদেক বাচ্চুর সঙ্গে তার ব্যক্তিগত সম্পর্কের বিষয়ে জানতে চাওয়া হয়। চলচ্চিত্রের বাইরে প্রয়াত অভিনেতা সাদেক বাচ্চুর সঙ্গে কেমন সম্পর্ক ছিল এ নির্মাতার? বিষয়টি জানতে চাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বেশ স্মৃতিকাতর হয়ে পড়লেন এফআই মানিক। বললেন, ‘সাদেক বাচ্চুর সঙ্গে আমার একটা আত্মিক যোগাযোগ ছিল। আমরা দুজনেই খুব আড্ডাপ্রিয়। দুজনে অনেক ভাবনা বিনিময় করতাম। কে ভালো কাজ করছেন, কেমন কাজ হচ্ছে, ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী—এসব নিয়ে অনেক কথা বলতাম। চলচ্চিত্র নিয়ে সামগ্রিক আলোচনা হতো।’

হাটের সার্জারি, ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপসহ নানা শারীরিক জটিলতায় ভুগছিলেন সাদেক বাচ্চু। সেই মলিনতা চোখ এড়াতে পারেনি এফআই মানিকের, ‘তিনি শেষের দিকে কথা কমই বলতেন। মনে হয় সবসময় একটা ইন্টারনাল সাফোকেশন ছিল। অনেকবার হাসপাতালে থাকতে হয়েছে। লাইফ সাপোর্টে আগেও ছিলেন। এমন পরিস্থিতিতে আসলে মৃত্যুকে দ্বারপ্রান্তে দেখে মানুষ। নিজের মধ্যে একটা প্রস্তুতি তৈরি হয়।’ এফআই মানিকের কথায়, অভিনেতা সাদেক বাচ্চুর বিদায় বাংলা চলচ্চিত্রের জন্য এক অপূরণীয় ক্ষতি।

0Shares

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *