চীনা প্রবৃদ্ধির হাত ধরে ঘুরে দাঁড়ানোর প্রত্যাশা বিশ্ব অর্থনীতির

গত বছরের সর্বশেষ প্রান্তিকে মহামারী-পূর্ব সময়ের চেয়েও চাঙ্গা প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে চীন। অক্টোবর-ডিসেম্বর প্রান্তিকে চীনের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৬ দশমিক ৫ শতাংশ। এতে পুরো বছরের প্রবৃদ্ধি দাঁড়িয়েছে ২ দশমিক ৩ শতাংশ। গতকাল প্রকাশিত সরকারি উপাত্তে এ তথ্য উঠে এসেছে। খবর এপি, ব্লুমবার্গ।

গতকাল চীনের জাতীয় পরিসংখ্যান ব্যুরো (এনবিএস) জানায়, গত বছরের চতুর্থ প্রান্তিকে চীনের জিডিপি বছরওয়ারি বেড়েছে ৬ দশমিক ৫ শতাংশ। তৃতীয় প্রান্তিকে ৪ দশমিক ৯ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছিল চীন। গত প্রান্তিকের জন্য রয়টার্স ও ব্লুমবার্গের জিডিপি প্রবৃদ্ধি পূর্বাভাস ছিল যথাক্রমে ৬ দশমিক ১ শতাংশ ও ৬ দশমিক ২ শতাংশ।

প্রধান অর্থনীতিগুলোর মধ্যে একমাত্র চীনই গত বছর সংকোচন এড়াল। চলতি বছরেও এ ধারা অব্যাহত রাখবে বলে আশা করছে চীন। রয়টার্সের এক জরিপে চলতি বছরের জন্য চীনের প্রবৃদ্ধি পূর্বাভাস ৮ দশমিক ৪ শতাংশ।

করোনা মহামারীর সূতিকাগার হলেও সবার আগে ঘুরে দাঁড়ানোয় বিশ্বে চমক সৃষ্টি করেছে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতিটি। শুরুতেই কঠিন লকডাউন কার্যকর, অন্যান্য দেশের তুলনায় সফলতার সঙ্গে সংক্রমণ ঠেকানো এবং কার্যকর সরকারি প্রণোদনায় ঘুরে দাঁড়িয়েছে চীনের অর্থনীতি। করোনায় ধুঁকতে থাকা দেশগুলোয় চিকিৎসা যন্ত্রপাতি, ঘরে বসে কাজ করার সামগ্রী রফতানিও এতে বিশাল ভূমিকা রেখেছে। এছাড়া অভ্যন্তরীণ বাজার চাঙ্গায় ভোক্তাদের হাতে সরকারি সহায়তা পৌঁছায় চীনের ভোক্তা খাত শক্তিশালী ছিল। গত বছরের প্রথম প্রান্তিকে করোনার চূড়ান্ত সময়ে দেশটির অর্থনীতি সংকুচিত হয়েছিল ৬ দশমিক ৮ শতাংশ। বছরের দ্বিতীয়ার্ধে ঘুরে দাঁড়ালেও বার্ষিক যে প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে, তা ১৯৭৬ সালের পর সর্বনিম্ন। ১৯৬৬ সালে শুরু হওয়া মাও জে দংয়ের সাংস্কৃতিক বিপ্লবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল চীনের অর্থনীতি। ১৯৭৬ সালে দেশটির অর্থনীতি সংকুচিত হয়েছিল ১ দশমিক ৬ শতাংশ। তারপর দেন শিওপিংয়ের নেতৃত্বে ব্যাপক অর্থনৈতিক সংস্কার আনা হয় চীনে। এতে এশিয়ার প্রভাবশালী অর্থনীতি হওয়ার পথে এগিয়ে যায় দেশটি।

চতুর্থ প্রান্তিকে চাঙ্গা প্রবৃদ্ধি করলেও সামনের দিনগুলো যে খুব চ্যালেঞ্জিং, সে রকম ইঙ্গিত দিচ্ছে এনবিএস কমিশনার নিং জিঝে। গতকাল তিনি বলেন, চীনের অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের ভিত্তি এখনো মজবুত নয়। মহামারীর দ্রুত পরিবর্তনশীল বিভিন্ন ডিনামিক্স নিয়ে এখনো অনেক অনিশ্চয়তা রয়েছে।

সর্বশেষ উপাত্তে দেখা গেছে, ২০২০ সালে চীনের শিল্প উৎপাদন বেড়েছে মাত্র ২ দশমিক ৮ শতাংশ, গত বছরগুলোর তুলনায় যা অনেক কম। শিল্প উৎপাদনের সঙ্গে সঙ্গে খুচরা বিক্রিও সংকুচিত হয়েছে ৩ দশমিক ৯ শতাংশ। প্রলম্বিত মহামারীতে ভোক্তাদের হাতে অর্থ গেলেও তারা অর্থ ব্যয়ে বেশ হিসেবি। নগর এলাকায় বেকারত্ব হার ৫ দশমিক ২ শতাংশ। অবশ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রকৃত বেকারত্বের হার সরকারি উপাত্তের চেয়ে বেশি। চীনের উল্লেখযোগ্য একটা অংশ অনানুষ্ঠানিক অর্থনীতিতে জড়িত। অক্সফোর্ড ইকোনমিকসের গবেষক লুই কুইজ জানান, নতুন করে সংক্রমণ বৃদ্ধিতে দুটি প্রদেশে ফের কঠোর বিধি-নিষেধ আরোপ এবং বিশ্বের বিভিন্ন দেশে লকডাউন জারিতে প্রথম প্রান্তিকে প্রবৃদ্ধি শ্লথ হবে।

এখন চীনের সামনে বেশ কয়েকটি চ্যালেঞ্জ অপেক্ষা করছে। শুধু বছর দেড়েক ধরে বেইজিং-ওয়াশিংটনের বিরোধ, বাইডেন প্রশাসনের সঙ্গে সম্পর্ক কেমন হবে তা-ই নয়, বরং ক্রমবর্ধমান শ্রমব্যয়, বয়স্ক জনগোষ্ঠীর সংখ্যা বৃদ্ধি, সাম্প্রতিক ঋণখেলাপির সংখ্যা বৃদ্ধি চীনের অর্থনীতির সামনে বিশাল ঝুঁকি হিসেবে হাজির হয়েছে। কিছু বিশ্লেষক সতর্ক করে বলছেন, উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় কয়েকটি রাজ্যে করোনা সংক্রমণ বৃদ্ধিতে আগামী মাসে চীনা চান্দ্র বর্ষের ছুটিতে ভোক্তাব্যয় অন্য বছরগুলোর মতো বাড়বে না।

নীতিনির্ধারক পর্যায়ের কয়েকটি সূত্রের বরাতে রয়টার্স জানায়, আগামী মাসগুলোয় বেঞ্চমার্ক সুদের হার অপরিবর্তিত রাখতে পারে চীনের কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

বিশ্বব্যাংক বলছে, চীনের বার্ষিক প্রবৃদ্ধি যদিও চার দশকের সর্বনিম্ন, তবে বিশ্বের অন্যান্য প্রান্তে সংকোচনের মানে দাঁড়াচ্ছে, বৈশ্বিক অর্থনীতিতে চীনের শেয়ার বাড়বে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) পূর্বাভাস, ২০২৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রকে হটিয়ে বিশ্বের শীর্ষ অর্থনীতি হবে চীন। পূর্বের পূর্বাভাসের চেয়ে দুই বছর আগেই এ জায়গায় পৌঁছবে এশিয়ার শীর্ষ অর্থনীতিটি। এছাড়া চলতি দশকে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক কার্যক্রমে চীনের অবদান থাকবে এক-চতুর্থাংশ।

0Shares

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *