কাঁচামাল সংকটে দেশীয় তামা পণ্য উৎপাদন কারখানা

করোনাভাইরাসের প্রকোপ ফের বাড়তে শুরু করায় বৈশ্বিক পণ্যবাজার অস্থির হয়ে উঠেছে। বিশ্বব্যাপী কপার বা তামাসহ শিল্পের কাঁচামালের দাম বৃদ্ধি ও সরবরাহ সংকট দেখা দিয়েছে। এতে বিপাকে পড়েছে বাংলাদেশের তামাজাত পণ্য উৎপাদনকারী কারখানাগুলোও। কয়েক মাসের ব্যবধানে তামার বুকিং দাম প্রায় দ্বিগুণ বেড়েছে। এতে কাঁচামাল সংকটে উৎপাদন বন্ধের শঙ্কায় পড়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত তামার তার উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান গাজী ওয়্যারসসহ বেসরকারি কারখানাগুলো।

বাংলাদেশে তামার মূল চাহিদা বিভিন্ন গ্রেডের তার বা ওয়্যার তৈরিতে। এসব তার দিয়ে ট্রান্সফরমার, মোটর, ফ্যান ও বিভিন্ন যন্ত্রের কয়েল তৈরি হয়। তামার তার ব্যবহূত হয় বৈদ্যুতিক পাখাসহ বিভিন্ন ইলেকট্রিক পণ্য ও মেশিনারিজের কয়েল তৈরিতেও। দেশে তামার তারের বাজার বছরে প্রায় তিন হাজার টন। এর মধ্যে শীর্ষ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে রয়েছে বাংলাদেশ ইস্পাত ও প্রকৌশল করপোরেশনের প্রতিষ্ঠান গাজী ওয়্যারস লিমিটেড। প্রতিষ্ঠানটি প্রতি বছর ৬০০ টন বিভিন্ন গ্রেডের তামার তার তৈরি করে। মূলত পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড, বিপিডিবি, ডেসকো, বিজেএমসি, উত্তরাঞ্চলের বরেন্দ্র বহুমুখী প্রকল্পের বিভিন্ন ক্ষমতার ট্রান্সফরমার ও মোটরের কয়েল সংযোজনে সুপার এনামেল কপার ওয়্যার ব্যবহূত হয়। এছাড়া দেশের বিভিন্ন ফ্যান, এসিসহ ইলেকট্রিক পণ্য উৎপাদনকারী কারখানাগুলো গাজী ওয়্যারস থেকে তামার তার ক্রয় করে।

তবে নতুন করে বিশ্বব্যাপী কভিড-১৯-এর সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন দেশে খনি, কারখানাসহ সার্বিক উৎপাদন কার্যক্রম ব্যাহত হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে লন্ডন মেটাল এক্সচেঞ্জসহ বিভিন্ন নিলাম ও বাজারে ধাতুজ পণ্যটির দাম গত কয়েক মাসে অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যায়। কিছুদিন আগেও টনপ্রতি কপার শিট বিশ্ববাজারে বিক্রি হয়েছে ৫ হাজার ৫০০ থেকে ৬ হাজার ডলারের মধ্যে। কিন্তু গত এক মাসে পণ্যটির দাম বেড়ে মণপ্রতি ৯ হাজার ৯০০ ডলারে উঠে গেছে। প্রায় প্রতিদিনই কাঁচামালের দাম বৃদ্ধিতে আমদানি ও উৎপাদন নিয়ে শঙ্কায় পড়েছে তার উৎপাদনকারী দেশীয় কোম্পানিগুলো।

দেশের শীর্ষ তামাজাত পণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান গাজী ওয়্যারস সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশে তামার কাঁচামাল আমদানি হয় মূলত ইন্দোনেশিয়া থেকে। কয়েক মাসের ব্যবধানে তামার দাম টনপ্রতি ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ বেড়ে যায়। সম্প্রতি কাঁচামালের দাম বৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে ধাতুজ পণ্যটির দাম ২৬ শতাংশ বাড়িয়েছে গাজী ওয়্যারস। সর্বশেষ গত ৪ মে নতুন করে তামা আমদানির জন্য ঋণপত্র খুলেছে প্রতিষ্ঠানটি। যেখানে ব্যয় হয়েছে টনপ্রতি ৯ হাজার ৩৫৫ ডলার। তাছাড়া বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে শিপিং জটিলতায় জাহাজীকরণে সময়ক্ষেপণ, পরিবহন খরচ বৃদ্ধিজনিত কারণে দেশের তামার তার উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর কারখানা চালু রাখা নিয়েও শঙ্কায় পড়েছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গ্রীষ্মকালীন মৌসুমের কারণে দেশে তামার তারের চাহিদা বেড়ে গেছে। গরমের কারণে ফ্যানের উৎপাদন ও বিক্রি বেড়ে যাওয়ায় বাড়তি এ চাহিদা দেখা দিয়েছে। তবে বৈশ্বিক দাম বৃদ্ধিজনিত কারণে অনেক প্রতিষ্ঠান পর্যাপ্ত কাঁচামাল আমদানি করতে পারেনি। এ কারণে এক সপ্তাহ ধরে কাঁচামালের মজুদ ফুরিয়ে এসেছে। এতে উৎপাদন সংকটে পড়েছে কারখানাগুলো।

যদিও অনেক প্রতিষ্ঠান বর্তমানে বাড়তি দামে তামা আমদানি শুরু করেছে। তবে দেশীয় গ্রাহক বা ক্রেতাদের কাছে আমদানি মূল্যের বর্ধিত দাম পাওয়া যাচ্ছে না। যার কারণে বেসরকারি খাতের প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যবহারিক ধাতুটির আমদানি ও উৎপাদন কমিয়ে দিয়েছে। ফলে চাহিদা বাড়লেও দেশে হঠাৎ করেই তামার তারের সংকট তৈরি হয়েছে বলে জানিয়েছেন খাতসংশ্লিষ্টরা।

দেশে গাজী ওয়্যারস ছাড়াও বিআরবি কেবলস, সুপার সাইনসহ বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান তামার তার উৎপাদন করে। দেশের বার্ষিক মোট চাহিদা তিন হাজার টন হলেও শুধু গাজী ওয়্যারস ৬০০ টন সরবরাহ করে। দেশে উৎপাদন ছাড়াও বিশ্ববাজার থেকে সরাসরি আমদানি এবং স্ক্র্যাপ বাজার থেকেও তামার তার সংগ্রহ করেন ব্যবসায়ীরা। দেশীয় চাহিদা মেটাতে বাংলাদেশ ইস্পাত ও প্রকৌশল করপোরেশন বার্ষিক ২ হাজার টন উৎপাদনক্ষমতাসম্পন্ন নতুন একটি ওয়্যারস কারখানা স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছে। এটি বাস্তবায়ন হলে দেশের তামার তারের ৮০-৯০ শতাংশই সরকারি প্রতিষ্ঠান চাহিদা মেটাতে সক্ষম হবে।

বিশ্ববাজারে তামার অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় দেশে ধাতুজ পণ্যটির উৎপাদন ও বিপণনে সংকট তৈরি হয়েছে বলে জানান গাজী ওয়্যারসের প্রধান প্রকৌশলী মো. আকতার হোসেন। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, গাজী ওয়্যারস রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান হিসেবে লাভজনক অবস্থায় আছে। তবে চলতি বছর প্রথমবারের মতো লোকসানের শঙ্কায় পড়েছে। প্রায় দ্বিগুণ দামে কাঁচামাল আমদানি করা হয়েছে। কিন্তু উৎপাদিত তারের দাম বাড়ানো হয়েছে মাত্র ২৬ শতাংশ। আগামীতে দাম আরো বেড়ে গেলে এবং চাহিদা অনুযায়ী কাঁচামাল পাওয়া না গেলে দেশে উৎপাদন কমিয়ে দেয়া ছাড়া উপায় থাকবে না বলেও জানান এ কর্মকর্তা।

0Shares

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *