‘কনসার্টগুলোকে বলতাম পপ শো’

সত্তর দশকের জনপ্রিয় ব্যান্ড ফিডব্যাকের প্রতিষ্ঠাতা ও কিবোর্ডিস্ট ফুয়াদ নাসের বাবু। ব্যান্ড ক্যারিয়ার ছাড়া সংগীতপরিচালক ও প্রযোজক হিসেবেও স্বনামধন্য এ ব্যান্ড শিল্পী। বাংলাদেশে ব্যান্ড সংগীতের ইতিহাস, বিস্তৃতি ও বর্তমান অবস্থা নিয়ে তিনি কথা বললেন বণিক বার্তার সঙ্গে। সাক্ষাত্কার নিয়েছেন সৈয়দ মেহরাজ কবির

আপনি বাংলাদেশে ব্যান্ড সংগীতের ইতিহাসের সাক্ষী। ব্যান্ড সংগীত একটি আলাদা ঘরানা। গতানুগতিক আধুনিক গানের ধরন থেকে বেরিয়ে ব্যান্ড ফরম্যাট এ দেশে কীভাবে প্রবেশ করল? শুরুটা কেমন ছিল?

এটা পুরোপুরি পাশ্চাত্যনির্ভর ছিল। তখন দ্য বিটলস, দ্য ডোরস—এসব ব্যান্ডের গান শুনে আমাদের দেশের তরুণ, কিশোররা অনুপ্রাণিত হয়েছিল। সেখান থেকেই এ দেশে ব্যান্ড ধারণার উত্পত্তি। মূলত এরা ছিল মিশনারি স্কুলের শিক্ষার্থী। কিছু অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান ছিল, যারা এখন এ দেশে নেই। তাদের দেখে আমাদের দেশের তরুণরাও ব্যান্ড তৈরি করতে অনুপ্রাণিত হয়।

বাংলাদেশের প্রথম ব্যান্ড বলতে আইওলাইটসের নাম আসে…

হ্যাঁ, ঢাকা থেকে ‘আইওলাইটস’ ছিল। ষাটের দশকের মাঝামাঝি সময়ের ব্যান্ড। একই সময় চট্টগ্রামে ‘লাইটনিংস’ বলে একটা ব্যান্ড ছিল। সমসাময়িক আরো অনেক ব্যান্ড ছিল। ‘স্ট্রেঞ্জারস’, ‘র‌্যাম্বলিং স্টোনস’—এগুলো সবই স্বাধীনতার আগের ব্যান্ড। এরা মূলত ইংরেজি গানই করত। আমার মনে আছে, তখন টিভিতে দু-একটা ব্যান্ড সামার ওয়াইন ও আরো কয়েকটি ইংরেজি গান বাংলা করে পারফর্ম করেছিল। স্বাধীনতার পর আজম ভাইয়ের (আজম খান) এবং স্পন্দনের যে ধারাটা শুরু হলো সেখান থেকেই বলা যায় বাংলা রক বা বাংলা পপ ব্যান্ড সংগীতের সূচনা।

স্বাধীনতার আগে ধারাটি কি মূলত পপ ছিল?

পপ, রক। তখন এগুলোই ছিল। স্বাধীনতার পর আমরা পপ মিউজিকই বলতাম। কারণ আমার মনে আছে তখন ছুটির দিন ছিল রোববার। এ রোববারে কনসার্টগুলো হতো। এ কনসার্টগুলোকে আমরা বলতাম পপ শো। তখন ‘উচ্চারণ’, ‘উইন্ড অব কেয়ার’, ‘স্পন্দন’ এরা পারফর্ম করত।

এ পপ শোগুলো মূলত কোথায় হতো?

তখন ঢাকা ইন্টারকন্টিনেন্টালে এ পপ শোগুলো হতো। এছাড়া বাংলামোটরে ড্যাফোডিল হোটেলে, লেডিজ ক্লাবে ইংরেজি গান কভার করত ব্যান্ডগুলো। দর্শক-শ্রোতারা ছিল মূলত বিদেশী। এছাড়া বাংলাদেশীও ছিল কয়েকজন। ঢাকা ইন্টারকন্টিনেন্টালে বল ডান্স হতো। এ বল ডান্সগুলোর সঙ্গে ব্যান্ড পারফরম্যান্সও হতো। তারপর ডিম্পল রেস্তোরাঁ ছিল। সেখানে লাইভ মিউজিক হতো।

বাদ্যযন্ত্রের কথা যদি বলি, স্বাধীনতার আগে তখন ছিল হারমোনিয়াম, বাঁশি বা তবলা। ওই সময়ে গিটার বা ড্রামস কীভাবে সংগ্রহ করতে হতো?

তখন তো বাদ্যযন্ত্রের প্রাপ্যতা ছিল না। এখন যেমন দোকানে গিয়ে আমরা কিনতে পারি। তখন সে প্রশ্নই আসে না। এমনকি আমরা যখন স্বাধীনতার পরে ব্যান্ড তৈরি করেছি, তখন এক সেট গিটারের তারই পাওয়া যেত না। তখন সবাই বিদেশ থেকেই বাদ্যযন্ত্র কিনে আনত। আর চট্টগ্রামের একটা সুবিধা ছিল জাহাজ থেকেই এগুলো কিনতে পাওয়া যেত।

সেটা তো একদম শুরুর কথা। ব্যান্ড সংগীতের প্রথম প্রজন্ম। গান শেখার উপায় কী ছিল?

তখন বিদেশী ব্যান্ডের ক্যাসেট বারবার শুনে শুনেই আমরা চেষ্টা করতাম গানগুলো তুলতে। কিন্তু হ্যাঁ, কর্ড বা বেসিক কিছু গ্রামার শিখতে হতো বই পড়ে। লাইব্রেরি, ব্রিটিশ কাউন্সিল, পুরনো বইয়ের দোকানে তখন আবার কর্ড শেখার জন্য বই কিনতে পাওয়া যেত। কারণ তখন তো আর ইন্টারনেট ছিল না। কাজেই সবাই সেখান থেকেই শিখত। আমার মনে আছে তখন ড্যান মরগ্যানের একটা দারুণ বই ছিল গিটারিস্টদের জন্য।

ব্যান্ডের সংখ্যা ধীরে ধীরে বাড়তে শুরু করল কখন? স্বাধীনতার পর?

হ্যাঁ, তা অবশ্যই। স্বাধীনতার পরই। কিন্তু বড় পরিসরে বাড়তে শুরু করল অডিও ইন্ডাস্ট্রি আসার পর। প্রথম উদ্যোগ নেয় সারগাম প্রডাকশন হাউজ। যার নাম এখানে নেয়া উচিত অবশ্যই—বাদল বলে একটা ছেলে। তার আইডিয়া থেকেই সে সময় ব্যান্ডের গান ক্যাসেট আকারে বের করা শুরু হলো। অনেক পরিশ্রমী ছিল। প্রত্যেক ব্যান্ডের সদস্যদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে ক্যাসেট করতে বলত। আমার বাসায় এসেও প্রায়ই বলত। তখন আমাদের গানগুলো প্রচার হলো। আমাদের গানগুলোও মানুষ শুনতে পেল। এটার কৃতিত্ব তাকে দিতেই হবে। ঢাকা রেকর্ড বলে আরো একটা কোম্পানি ছিল। ইপি (এক্সটেন্ডেড প্লে) রেকর্ডে কিছু সুপারহিট গান বের করেছিল ওরা। ওই রেকর্ডটা কলকাতাতেও প্রচুর বিক্রি হয়। ঢাকা রেকর্ড থেকেই আজম ভাইয়ের সালেকা মালেকা, হাইকোর্টের মাজারে গানগুলো প্রকাশ হয়।

সবেমাত্র যখন ব্যান্ড সংগীত প্রচার হতে শুরু করল, তখন তা কতটা সমাদৃত হয়েছিল? সমালোচনাও কি ছিল?

সমালোচনা তো ছিল বটেই। এটাকে অপসংস্কৃতি বলা হতো…

কারা বলতেন এ রকম?

আমি নির্দিষ্ট করে কারো নাম নিতে চাইছি না। একদল রক্ষণশীল মানুষ ছিল। তারা ব্যান্ড গানকে অপসংস্কৃতি বলে প্রচার করত। তবে বিশেষ করে তরুণরা ব্যান্ড সংগীত ভালোভাবেই গ্রহণ করেছিল। তরুণরাই ছিল প্রধান শ্রোতা।

স্বাধীনতার পর কী কী পরিবর্তন আসে গানে? কী ধরনের এক্সপেরিমেন্ট হয়েছিল সে সময়?

স্বাধীনতার পরে চর্চা আরো বেগবান হয়। ধীরে ধীরে বাংলা গান করতেও শুরু করে ব্যান্ডগুলো। বাংলায় গান করাটাই তো একটা বড় এক্সপেরিমেন্ট ছিল। বাংলায় গান হওয়ার পর শ্রোতারা আরো সাড়া দেয়। দেশ স্বাধীনের আগে এক ধরনের স্ট্রাগল ছিল। স্বাধীন হওয়ার পর অন্য ধরনের স্ট্রাগল ছিল। তরুণরা চাকরি পাচ্ছে না, প্রাকৃতিক দুর্যোগ হচ্ছে। স্বাধীনতার পরের গানে এ পরিস্থিতি ফুটে ওঠে। যেহেতু ব্যান্ড গানের মূল শ্রোতাই ছিল তরুণ, যুবক। তাই তারাও এর সঙ্গে কানেক্ট করতে পারে।

বর্তমানে আন্ডারগ্রাউন্ডে বেশকিছু ভালো ব্যান্ড পারফর্ম করছে। এ আন্ডারগ্রাউন্ড ব্যান্ডগোষ্ঠী ঠিক কখন দৃশ্যপটে আসে?

আন্ডারগ্রাউন্ড ব্যান্ড সবসময়ই ছিল, এখনো আছে। আন্ডারগ্রাউন্ড আসলে একটা কালচার, যেটা পশ্চিমাদের আদলে এখানেও গড়ে ওঠে। মূলত কিছু ব্যান্ড নিজেদের মধ্যে পারফর্ম করত। পরে দেখা যায় এদের মধ্যে অনেকে খুব জনপ্রিয় হয়। তখন তো আর সে আন্ডারগ্রাউন্ড রইল না। তখন সে মূলধারায় এসে পড়ল। ‘আর্বোভাইরাস’, ‘নেমেসিস’ এ ব্যান্ডগুলো তো খুবই সক্রিয়। কাজেই এদের আন্ডারগ্রাউন্ড বললে ভুল হবে।

আপনি সবগুলো প্রজন্মেরই সাক্ষী। শ্রোতাদের মাঝে কী পরিবর্তন দেখছেন?

এখন উন্মাদনা কিছুটা কমেছে। প্রযুক্তি মানুষকে কাছে নিয়ে এসেছে এটা ঠিক, কিন্তু কিছু খারাপ দিকও আছে। মানুষের এখন অবসর নেই। যার কারণে একটা গান, একটা গোটা অ্যালবাম মনোযোগ দিয়ে শুনবে, সে তাগিদটা বোধ করছে না। ক্যাসেট বা সিডি সংগ্রহের জন্য যে অধীর অপেক্ষাটা ছিল, সেটা এখন আর নেই। কারণ গান এখন খুব সহজলভ্য। আগে মাঝরাত পর্যন্ত মানুষ অপেক্ষা করত সিডি কেনার জন্য। আমাকে একবার একজন বলেছিলেন, আপনার সিডিটা কিনব দেখে মাঝরাত থেকে অপেক্ষা করেছি। দোকান খুললে যেন সিডিটা শেষ হয়ে না যায়। উন্মাদনাটা তো এখন আর নেই। ফরম্যাট বদলের সঙ্গে শ্রোতামহলেও পরিবর্তন এসেছে। তবে এটা ভাবলে ভুল হবে যে ব্যান্ডের গান মানুষ শুনছে না। শুনছে, ব্যাপকভাবে গ্রহণও করছে।

ফিডব্যাক নিয়ে সামনে পরিকল্পনা কী?

সামনে একক গান প্রকাশের পরিকল্পনা আছে কয়েকটি। এছাড়া কনসার্টও করব।

অ্যালবাম প্রকাশের আগ্রহ নেই?

আমি তো খুবই আগ্রহী। একটা অ্যালবাম বের করতে পারলে খুবই খুশি হব। কিন্তু আজকাল তো সবাই একক গানই চাইছে। সব ব্যান্ডই তা-ই করছে। ওই যে প্রযুক্তির কারণেই এটা হয়েছে। সবাই একক গান প্রকাশ করছে।

0Shares

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *