একতরফা বাণিজ্য বন্ধ হলো বেনাপোল-পেট্রাপোলে

ভারতীয় কর্তৃপক্ষ রফতানি পণ্য না নেয়ায় গতকাল সকাল থেকে বেনাপোল-পেট্রাপোল বন্দর দিয়ে সিঅ্যান্ডএফ ব্যবসায়ী ও রফতানিকারকরা এক হয়ে আমদানি বাণিজ্য কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়েছে। গেল ১০০ দিনে বন্দর দিয়ে বাংলাদেশ থেকে কোনো পণ্য ভারতে রফতানি হয়নি। অথচ লকডাউনের ৭৭ দিনের মাথায় ভারতীয় পণ্য বাংলাদেশে আসা শুরু হয়। এ পরিপ্রেক্ষিতে বাধ্য হয়ে এমন বাণিজ্যকে একতরফা আখ্যা দিয়ে আমদানি কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন বেনাপোল কাস্টমসের অতিরিক্ত কমিশনার ড. নিয়ামুল ইসলাম।

বেনাপোল আমদানি-রফতানিকারক সমিতির সহসভাপতি আমিনুল হক বলেন, করোনা সংক্রমণের শঙ্কায় নিরাপত্তাজনিত কারণ দেখিয়ে ভারতীয়রা বাংলাদেশ থেকে কোনো পণ্য নিচ্ছে না। ফলে আমদানি কার্যক্রম স্বাভাবিক হয়ে গেলেও রফতানি হয়নি কিছুই। এমনিতেই ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের বড় বাণিজ্য ঘাটতি রয়েছে। একতরফাভাবে রফতানি আটকে রাখায় এ ঘাটতি আরো বাড়ছে। এমন পরিস্থিতিতে আমরা বহু দেনদরবার করেও বাংলাদেশের পণ্য ভারতে রফতানি করতে ব্যর্থ হয়েছি। তাই বাধ্য হয়ে আজ আমদানি-রফতানি কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।

দেশে স্থলপথে যে রফতানি হয়, তার প্রায় ৭০ শতাংশ ভারতে যায় বেনাপোল বন্দর দিয়ে।

প্রতি বছর এ বন্দর দিয়ে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা মূল্যের নয় হাজার টন বাংলাদেশী পণ্য ভারতে রফতানি হয়। কিন্তু ভারত থেকে পণ্য আসে এর বহুগুণ।

বন্দর সূত্রে জানা গেছে, করোনার মধ্যে আড়াই মাস বন্ধ থাকার পর গত ৭ জুন বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে ভারতের সঙ্গে আমদানি বাণিজ্য স্বাভাবিক হয়। এ সময় থেকে ভারতে প্রবেশের অপেক্ষায় বেনাপোল বন্দরে কমপক্ষে দুই শতাধিক ট্রাক রফতানিযোগ্য পণ্য নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। রোদ, বৃষ্টিতে যেমন পণ্যের গুণগত মান নষ্ট হচ্ছে, তেমনি ব্যবসায়ীদের লোকসানের পাল্লাও ভারী হচ্ছে। এ অবস্থায় বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা স্থলপথে ভারতীয় ব্যবসায়ীদের সঙ্গে রফতানি বাণিজ্য সচলের জন্য বারবার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। আমদানিতে ‘হ্যাঁ’ বললেও রফতানিতে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ ‘না’ বলেই চলেছে। আমদানি উন্মুক্ত হওয়ার পর গত ৭ জুন থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত ভারত থেকে ৪ হাজার ২০০ ট্রাক পণ্য বেনাপোল বন্দরে প্রবেশ করেছে। অথচ একটি রফতানি ট্রাকও গ্রহণ করেনি ভারতীয় কর্তৃপক্ষ।

বেনাপোলসহ আশেপাশের রফতানিকারকদের অভিযোগ, ভারতের সরকারি কর্তৃপক্ষের মনোভাব ছাড়াও পশ্চিমবঙ্গের বনগাঁ পৌরসভার মেয়রের খামখেয়ালিপনা, আমদানি-রফতানিতে নাক গলানো, পৌরসভার কালিতলায় পার্কিং সৃষ্টি করে বিভিন্ন রাজ্য থেকে আসা ট্রাকগুলোকে জোরপূর্বক পেট্রাপোল বন্দরের সেন্ট্রাল ওয়্যারহাউজ করপোরেশনের টারমিনালে না পাঠিয়ে চাঁদার দাবিতে কালিতলা পার্কিংয়ে রেখে দেয়ার কারণে বেনাপোল-পেট্রাপোল বন্দর দিয়ে দুই দেশের মধ্যে আমদানি-রফতানি কাজে বড় প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়েছে।

ব্যবসায়ীদের দাবি, ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার আমদানি-রফতানির অনুমতি দিলেও রাজ্য সরকারের একক সিদ্ধান্তের কারণে রফতানি কার্যক্রম স্বাভাবিক হচ্ছে না। সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে ভারতের রাজ্য সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি না করলে এর সুরাহা হবে না বলেও মনে করেন তারা।

বাংলাদেশ স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান তপন কুমার চক্রবর্তী বলেন, ভারতীয় কর্তৃপক্ষ আমাদের রফতানি পণ্য প্রবেশের অনুমতি দিচ্ছে না। আমরা বিভিন্ন মাধ্যমে তাদের একাধিকবার বলেছি রফতানি স্বাভাবিক রাখতে। কিন্তু লকডাউনের কারণে তারা রফতানির অনুমতি দিচ্ছে না।

তিনি আরো বলেন, বিষয়গুলো বিবেচনা করে আমরা তাদের বলেছি আমদানি-রফতানি কার্যক্রম স্বাভাবিক রাখার জন্য। সরকারি পর্যায়ে আলোচনা চলছে। আশা করছি, দ্রুত বিষয়টা সুরাহা হবে। কারণ আমরা আমদানি কার্যক্রম স্বাভাবিক রেখেছি।

ইন্দো-বাংলা চেম্বার অব কমার্স স্থলবন্দর সাব কমিটির পরিচালক মতিয়ার রহমান বলেন, বিষয়টি ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইকে অবগত করেছি। তারা বলেছেন, স্থলবন্দরগুলোয় রফতানিতে জটিলতা দেখা দিয়েছে। গভর্নমেন্ট টু গভর্নমেন্ট আলোচনা চলছে। গভর্নমেন্ট লেভেলে বিষয়টি দেখভাল হচ্ছে। আমরা বিষয়টি নিয়ে কাজ করছি। দুই দেশের কূটনৈতিক পর্যায়ে সমস্যা সমাধানে আলোচনা চলছে। আশা করছি, শিগগিরই সুরাহা হবে।

রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবির) পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বাংলাদেশের মোট বৈদেশিক বাণিজ্যের প্রায় ১০ শতাংশ এককভাবে ভারতের সঙ্গে হয়। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে দুই দেশের মোট বাণিজ্যের পরিমাণ ৮৯০ কোটি ডলার, যার সিংহভাগ পণ্য ভারত থেকে বাংলাদেশে এসেছে। এর মধ্যে বাংলাদেশ থেকে রফতানি হয় মাত্র ১২৫ কোটি ডলারের পণ্য। অর্থাৎ দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ ৭৬৫ কোটি ডলার। চলমান সংকটে ভারতে রফতানি বন্ধ থাকায় বাণিজ্য ঘাটতি ব্যাপক হারে বেড়ে যাবে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন সংশ্লিষ্টরা।

0Shares

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *