পুরোনো মেশিনে বিশ্ববাজারে পিছিয়ে পড়ছে পাট শিল্প

চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে (জুলাই-অক্টোবর) পাট ও পাটজাত পণ্য রফতানি করে আয় হয়েছে ৩৩ কোটি ৩০ লাখ ডলার। ২০২১-২২ অর্থবছরের একই সময়ে এ খাত থেকে আয়ের পরিমাণ ছিল ৪৩ কোটি ৮৮ লাখ ডলার। অর্থাৎ এক বছর ব্যবধানে রফতানি কমেছে ২৪ শতাংশেরও বেশি। বর্তমানে বিশ্বজুড়ে জোর দেয়া হচ্ছে সবুজায়নের প্রতি। ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত (ইইউ) দেশগুলো পলিথিন ব্যবহার বন্ধের সিদ্ধান্ত নেয়ায় বিশ্বব্যাপী পাটজাত পণ্যের চাহিদাও বাড়ছে। কিন্তু গবেষণায় ঘাটতি ও পুরনো মেশিন দিয়ে প্রতিনিয়ত নতুন পাটপণ্য উৎপাদন সম্ভব হচ্ছে না। এমনকি বাংলাদেশে উৎপাদিত পাটজাত পণ্যগুলো শতভাগ অর্গানিক হওয়া সত্ত্বেও প্রমাণ দেয়া যাচ্ছে না। তাই বিশ্ববাজারের প্রতিযোগিতায় টিকতে পারছে না দেশীয় পাটজাত পণ্য।

এ পরিস্থিতি মোকাবেলায় পাটকে অর্গানিক পণ্য হিসেবে প্রমাণে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের এক্সপোর্ট কমপেটিটিভনেস ফর জবস (ইসিফোরজে) প্রকল্পের আওতায় প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণের অনুরোধ জানিয়েছে বাংলাদেশ জুট মিল অ্যাসোসিয়েশন (বিজেএমএ)। সম্প্রতি অংশীজনদের নিয়ে পাট ও পাটজাত পণ্য রফতানির সমস্যা ও সম্ভাবনা পর্যালোচনা-সংক্রান্ত সভার আয়োজন করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মো. হাফিজুর রহমানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ওই সভায় সরকারের বিভিন্ন সংস্থার প্রতিনিধির পাশাপাশি পাট খাতের ব্যবসায়ীরা উপস্থিত থেকে তাদের সমস্যা ও সম্ভাবনার কথা জানান।

সভায় বাংলাদেশ জুট মিল অ্যাসোসিয়েশনের (বিজেএমএ) পক্ষ থেকে বলা হয়, বাংলাদেশের পাটকলগুলোর যন্ত্রপাতি অতি পুরনো হওয়ায় নতুন নতুন পণ্য উৎপাদনের মাধ্যমে বৈচিত্র্য আনায়ন সম্ভব হচ্ছে না। তাছাড়া বিদেশী ক্রেতারা বীজ থেকে উৎপাদন পর্যন্ত সব বিষয়ে ট্রেসিবিলিটি কমপ্লায়েন্স প্রতিপালন করার শর্ত আরোপ করে থাকে। কিন্তু পুরনো প্রযুক্তির মেশিন দিয়ে পণ্য বহুমুখীকরণ ও অর্গানিক পণ্য (জৈব সার ব্যবহার করে প্রাকৃতিকভাবে উৎপাদিত পণ্য) হিসেবে প্রমাণ করা দুরূহ হয়ে দাঁড়ায়। তাই বিশ্ববাজার প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা খুবই কঠিন হয়ে পড়েছে। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত পুরনো মেশিন পরিবর্তন করে আধুনিক মেশিন স্থাপন করায় তাদের পণ্যের চাহিদা ও দাম বেড়েছে। এক্ষেত্রে পুরনো জরাজীর্ণ মেশিন পরিবর্তন করে এক্ষেত্রে আধুনিক প্রযুক্তিসম্পন্ন মেশিন আনার জন্য সরকারকে এগিয়ে আশার আহ্বান জানায় সংগঠনটি। একই সঙ্গে পাটকে অর্গানিক পণ্য হিসেবে প্রমাণ করার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ হিসেবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ইসিফোরজে প্রকল্পের সহযোগিতাও কামনা করেছে তারা।

পাটকলগুলো আধুনিকায়ন করা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিজেএমএর চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান পাটওয়ারী বণিক বার্তাকে বলেন, বাংলাদেশের পাটকলগুলো এক সময় সরকারি ছিল। পরবর্তী সময়ে এগুলোকে বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেয়া হয়। কিন্তু বেসরকারীকরণের শুরু থেকেই মিলগুলোতে বিভিন্ন ধরনের সমস্যা ছিল। তাই কোনো ব্যাংক অর্থায়ন করতে রাজি হয়নি। ব্যাংকঋণ না পেয়ে এ খাতের উদ্যোক্তারা মিশনগুলোর উন্নয়ন করতে পারেনি। তাই পাট খাতে চরম দুর্গতি নেমে আসে। এক পর্যায়ে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের মিলগুলোরও একই অবস্থা ছিল উল্লেখ করে তিনি বলেন, ভারত সরকারের সহায়তায় দেশের মিলগুলো বর্তমানে আধুনিক প্রযুক্তিসম্পন্ন হয়েছে। তাই তাদের পণ্যের চাহিদাও বিশ্বব্যাপী বেড়েছে।

বিজেএমএ চেয়ারম্যান জানান, প্রথমদিকে ভারতের পাটকল মালিকরাও ব্যাংকঋণ পেতে প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হন। পরবর্তী সময়ে ভারত সরকার ঘোষণা দিয়েছিল, কোনো মালিক যদি পুরনো পাটকলগুলো পরিবর্তন করে আধুনিক পাটকল স্থাপন করেন, তাহলে তাদের ৩০ শতাংশ হারে প্রণোদনা দেয়া হবে। এতে করে মালিকরা সরকারের কাছ থেকে পাওয়া ৩০ শতাংশ এবং পুরনো মেশিন বিক্রি করে পাওয়া ১০ থেকে ২০ শতাংশ একই সঙ্গে ব্যাংক থেকে আরো ৫০ শতাংশ ঋণ নিয়ে তাদের মিলগুলো আধুনিকায়ন করেছেন। এখন তারা শতভাগ কমপ্লায়েন্স। তাদের পণ্যের চাহিদা ও মূল্য দুটোই বেশি। তিনি বলেন, আমাদের পাটপণ্য শতভাগ অর্গানিক হওয়া সত্ত্বেও প্রযুক্তির অভাবে বিদেশী ক্রেতাদের তার প্রমাণ দিতে পারি না। এর ফলে আমরা পিছিয়ে পড়ছি। পাটজাত পণ্যগুলো অর্গানিক প্রমাণ করতে পারলে দেশীয় পাটজাত পণ্যের দামও পাঁচ গুণ বেড়ে যেত বলে জানান এ ব্যবসায়ী। তাই শতভাগ স্থানীয় মূল্যসংযোজনের এ খাতকে এগিয়ে নিয়ে ভারতের মতো সরকারের সহযোগিতা কামনা করেন বিজেএমএ চেয়ারম্যান।

সভায় অংশ নিয়ে ক্রিয়েশন প্রাইভেট লিমিটেডের এমডি মো. রাশেদুল করীম মুন্না বলেন, পাটজাত পণ্য বহুমুখীকরণে গবেষণা প্রয়োজন। এ কাজে দেশের ইনস্টিটিউটগুলো অনেক পিছিয়ে রয়েছে। তিনি আরো বলেন, আমাদের অন্য দেশের বীজের ওপর নির্ভর করতে হয়। ভারত থেকে ৯৫ শতাংশ পাটবীজ আমদানি করা হয়। এজন্য একটি দীর্ঘমেয়াদি পলিসি নেয়া দরকার। এছাড়া বাংলাদেশ জুট গুডস এক্সপোর্টার অ্যাসোসিয়েশন গঠন করা হলেও তা এখনো সরকারের অনুমোদন পায়নি। অ্যাসোসিয়েশনটি অনুমোদিত হলে সংশ্লিষ্ট কার্যক্রম আরো গতিশীল হতো।

গোল্ডেন জুট প্রডাক্টের স্বত্বাধিকারী মো. হাকিম বলেন, পাটজাত পণ্য বহুমুখীকরণে অনেক শ্রমিক জড়িত। কিন্তু তাদের নির্দিষ্ট কোনো বেতন কাঠামোর আওতায় আনা সম্ভব হয়নি। এজন্য বিভিন্ন সময় বিভিন্ন মন্ত্রণালয় কমপ্লায়েন্স প্রতিপালনের জন্য চাপ দিয়ে থাকে। এ খাতের শ্রমিকদের জন্য সরকারের সমন্বিত একটি গাইডলাইন দরকার। তিনি আরো বলেন, বৈচিত্র্য পাটপণ্যের জন্য নির্দিষ্ট কোনো এইচএস কোড নেই। তাই একেক সময় একেক এইচএস কোড ব্যবহার করে পণ্য রফতানির সময় কাস্টমস, ব্যাংকসহ অন্যান্য সংস্থার কাছে হয়রানির শিকার হতে হয়।

এ প্রসঙ্গে সার্বিকভাবে জানতে চাইলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মো. হাফিজুর রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, পাট ও পাটজাত পণ্য রফতানিতে বাধা ও সম্ভাবনা পর্যালোচনার খাত সংশ্লিষ্টদের নিয়ে বৈঠকের আয়োজন করা হয়েছিল। সেখানে ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন ধরনে সমস্যার কথা জানিয়েছেন। ব্যবসায়ীদের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনকে বৈচিত্র্য পাটজাত পণ্যের জন্য এইচএস কোড বিষয়ে স্টাডি করে শিগগির বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠাতে বলা হয়েছে। এছাড়া পাট ও পাটজাত পণ্যের সম্ভাবনা নিয়ে দেশী-বিদেশী প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে গবেষণার সুপারিশ এসেছে। এছাড়াও বিভিন্ন জন বিভিন্ন সমস্যার কথা জানিয়েছে। যেগুলো সমাধান শুধু বাণিজ্য মন্ত্রণালয় একার পক্ষে সম্ভব নয়। তাই সভায় সুপারিশগুলো পর্যালোচনা করা হচ্ছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের আওতার সমস্যাগুলো সমাধানে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এছাড়া অন্যান্য মন্ত্রণালয়সংশ্লিষ্ট সমস্যাগুলো সমাধানে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোকে অনুরোধ জানানো হবে।

0Shares

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *