টিকটক ফেসবুক-টুইটার ইউটিউবের চেয়েও বিপজ্জনক?

বৈশ্বিক সোস্যাল মিডিয়া জায়ান্ট ফেসবুক, মাইক্রোব্লগিং সাইট টুইটার এবং সার্চ জায়ান্ট গুগল নিয়ন্ত্রিত ভিডিও শেয়ারিং সেবা ইউটিউবসহ অসংখ্য প্রতিষ্ঠান ব্যবহারকারীর তথ্য সংগ্রহ, স্টোর এবং ব্যবসায় ফায়দা নিতে ব্যবহার করে আসছে। প্রশ্ন দেখা দিয়েছে চীনভিত্তিক বাইটডান্স নিয়ন্ত্রিত টিকটকের ক্ষেত্রে সমস্যা কোথায়?

জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি উল্লেখ করে টিকটক নিষিদ্ধে গত ৬ আগস্ট এক নির্বাহী আদেশে সই করেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। একই দিন টিকটকের যুক্তরাষ্ট্রের কার্যক্রম সেদেশের কোনো প্রতিষ্ঠানের কাছে বিক্রির নির্দেশ দেয়া হয়। ট্রাম্পের ওই নির্দেশনা মেনে এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের কার্যক্রম বিক্রির লক্ষ্যে ওরাকল করপোরেশনের সঙ্গে একটি চুক্তিতে পৌঁছেছে বাইটডান্স। সর্বশেষ গত শুক্রবার যুক্তরাষ্ট্রে অ্যাপ স্টোর থেকে টিকটকসহ আরেক চীনা অ্যাপ উইচ্যাট সরানোর নির্দেশ দেয় ট্রাম্প প্রশাসন, যা বিপুল ব্যবহারকারীর আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে স্থগিত করেন এক মার্কিন বিচারক।

এ বিষয়ে মার্কিন বাণিজ্যমন্ত্রী উইলবার রস বিবৃতিতে জানান, টিকটক ও উইচ্যাট অ্যাপ ঘিরে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সিদ্ধান্তে আরো একবার প্রমাণিত হয় যে জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে তিনি তার ক্ষমতার সর্বোচ্চ ব্যবহার করবেন। চীনের কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা রয়েছে এমন সব চীনা অ্যাপ ও সেবার বিরুদ্ধে ক্রমান্বয়ে ব্যবস্থা নেবেন তিনি। মার্কিনিদের তথ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতে ডোনাল্ড ট্রাম্পের এমন কঠোর সিদ্ধান্ত নেয়া।

গত শনিবার ডোনাল্ড ট্রাম্প সাংবাদিকদের বলেন, টিকটকের যুক্তরাষ্ট্রের কার্যক্রম অধিগ্রহণে ওরাকল ও ওয়ালমার্টের চুক্তিতে তার পূর্ণ সমর্থন রয়েছে। বহুল আলোচিত এ চুক্তিতে আমি অনুমোদন দিয়েছি। ওরাকল ও ওয়ালমার্ট টিকটক অধিগ্রহণে চুক্তিতে পৌঁছালে সেটা দারুণ কাজ হয়েছে। যদি তারা চুক্তিতে পৌঁছাতে না পারে তাহলেও ঠিক আছে। পরবর্তী সময়ে আমরা দেখব টিকটকের যুক্তরাষ্ট্রের কার্যক্রম নিয়ে আমরা কী করতে পারি। ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসনের অভিযোগ, টিকটক এবং উইচ্যাটের মাধ্যমে সংগৃহীত মার্কিনিদের তথ্যে চীন সরকারের অবাধ প্রবেশের সুযোগ রয়েছে।

এ বিষয়ে ওয়েডবুশ সিকিউরিটিজের বিশ্লেষক ড্যানিয়েল আইভস বলেন, ট্রাম্প প্রশাসন টিকটকের সংগৃহীত ডাটা বেইজিংয়ের ধরাছোঁয়ার বাইরে রাখতে চাইছেন। কারণ টিকটক অন্যান্য সোস্যাল মিডিয়া প্লাটফর্মের মতোই ব্যবহারকারীদের ব্যক্তিগত তথ্য সংগ্রহ এবং স্টোর করে আসছে।

তিনি বলেন, মার্কিন কিংবা চীনা হোক, সব সোস্যাল মিডিয়া প্লাটফর্মই ব্যবহারকারীর তথ্য সংগ্রহের কার্যক্রম পরিচালনা করছে। চীনের বাইটডান্স নিয়ন্ত্রিত টিকটক অ্যাপের এ ধরনের অনুশীলন নিয়ে বড় উদ্বেগের কারণ হলো ব্যাকডোর। কারণ কোনো না কোনোভাবে এ ব্যাকডোর কাজে লাগিয়ে টিকটকের ব্যবহারকারীদের তথ্যে প্রবেশাধিকার পাচ্ছে চীন সরকার, যা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ এবং উদ্বেগের বিষয়। অর্থাৎ ব্যবহারকারীর তথ্য ইস্যুতে ফেসবুক, গুগল কিংবা অন্য মার্কিন প্রতিষ্ঠানগুলোর অনুশীলন এবং টিকটকের অনুশীলন ও ব্যবহারে বিস্তর ফারাক দৃশ্যমান।

অবশ্য টিকটক বরাবরই তাদের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে। প্রতিষ্ঠানটির দাবি, তারা মার্কিন গ্রাহকের তথ্য চীনে স্টোর করে না এবং চীন সরকারের কাছে কোনো ধরনের তথ্য হস্তান্তর করে না।

বিশ্লেষকদের ভাষ্যে, নির্দিষ্ট শ্রেণীর গ্রাহককে লক্ষ্য করে বিজ্ঞাপন প্রচারের জন্য বিভিন্ন অনলাইন প্লাটফর্মের ব্যবহারকারীর তথ্য পর্যালোচনা করা এখন অত্যন্ত শক্তিশালী ও আকর্ষণীয় একটি ব্যবসা কৌশলে পরিণত হয়েছে। অনেক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান তথ্য পর্যালোচনা করে নির্দিষ্ট শ্রেণীর গ্রাহকের কাছে কাঙ্ক্ষিত পণ্য পৌঁছাতে পারছে।

শুধু টিকটক কিংবা উইচ্যাট নয়; যুক্তরাষ্ট্র ও কয়েকটি মিত্র দেশ নিরাপত্তা দুর্বলতার অজুহাত দেখিয়ে চীনভিত্তিক হুয়াওয়ের টেলিযোগাযোগ নেটওয়ার্ক সরঞ্জাম বর্জনে সক্রিয়ভাবে কাজ করছে। অথচ একই ধরনের অভিযোগ বারবার সামনে এলেও ফেসবুক ও গুগলের মতো ডিজিটাল জায়ান্টগুলোর ক্ষেত্রে নিশ্চুপ রয়েছে। বৈশ্বিক ডিজিটাল প্রতিষ্ঠানগুলোর তথ্যনিরাপত্তা ব্যবস্থা এবং গ্রাহক তথ্য কী কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে তা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের দ্বৈত ও বৈষম্যমূলক আচরণে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, প্রকৃত অর্থে কি টিকটক, উইচ্যাট কিংবা হুয়াওয়ে সোস্যাল মিডিয়া জায়ান্ট ফেসবুক ও সার্চ জায়ান্ট গুগলের চেয়ে বেশি বিপজ্জনক?

বিশ্বের অন্যান্য দেশের পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রেও ব্যাপক জনপ্রিয় একটি ভিডিও শেয়ারিং প্লাটফর্ম টিকটক। দেশটিতে এ অ্যাপের সক্রিয় ব্যবহারকারী ১০ কোটির মাইলফলক অতিক্রম করেছে।

টিকটক, উইচ্যাট কিংবা হুয়াওয়েসহ অন্য চীনা প্রতিষ্ঠানগুলো গ্রাহক তথ্য সংগ্রহ করছে এমন অভিযোগ করা হলেও এখন পর্যন্ত কোনো তথ্য-প্রমাণ মেলেনি। অথচ যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ফেসবুক ও গুগলের গ্রাহক তথ্য সংগ্রহের কার্যক্রম প্রযুক্তিবিশ্বে সবারই জানা। গ্রাহক তথ্যের অপব্যবহার নিয়ে গত বছর একাধিকবার সিনেট শুনানিতে অংশ নিয়েছিলেন ফেসবুকের সহপ্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মার্ক জাকারবার্গ এবং গুগলের সিইও সুন্দর পিচাই। এসব শুনানিতে গ্রাহক তথ্য সংগ্রহ ও তা বিভিন্ন ব্যবসার কাজে ব্যবহারের কথা স্বীকারও করা হয়েছে। অর্থাৎ ফেসবুক ও গুগলের দ্বারা গ্রাহক তথ্যের অপব্যবহারের অভিযোগ প্রমাণিত হলেও উভয় প্রতিষ্ঠান বহাল তবিয়তে ব্যবসা পরিচালনা করছে। অন্যদিকে শুধু আশঙ্কানির্ভর অভিযোগের ভিত্তিতে ক্রমবর্ধমান চীনা প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রবৃদ্ধি থামাতে একের পর এক সমালোচিত পদক্ষেপ নিয়ে চলেছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। এটা কতটা যৌক্তিক তা নিয়ে আলোচনা জোরালো হচ্ছে।

হুয়াওয়ে শুধু বিশ্বের বৃহৎ টেলিযোগাযোগ নেটওয়ার্ক সরঞ্জাম এবং দ্বিতীয় বৃহৎ স্মার্টফোন নির্মাতাই নয়; পঞ্চম প্রজন্মের আল্ট্রা-হাই-স্পিড মোবাইল নেটওয়ার্ক ফাইভজি অবকাঠামো নির্মাণেও নেতৃত্ব দিচ্ছে। ফাইভজি অবকাঠামো নির্মাণ এবং বাণিজ্যিক ব্যবহার শুরুতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিদ্বন্দ্বীদের চেয়ে প্রতিষ্ঠানটির অবদান বেশি। হুয়াওয়ে কয়েকটি চীনা প্রতিষ্ঠানকে সঙ্গে নিয়ে এককভাবে পশ্চিম ইউরোপ, এশিয়া ও আফ্রিকার প্রায় ২৩০টি শহরে সার্ভিল্যান্স সরঞ্জাম সরবরাহ করছে।

টিকটক ও উইচ্যাটের মতোই ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসনের অভিযোগ হুয়াওয়ের টেলিযোগাযোগ নেটওয়ার্ক সরঞ্জামে সূক্ষ্ম ব্যাকডোর আছে। নিজেদের সরঞ্জামের মাধ্যমে মার্কিনিদের ওপর গুপ্তচরবৃত্তির কার্যক্রম পরিচালনা করছে প্রতিষ্ঠানটি। এসব তথ্য পরবর্তী সময়ে ব্যাকডোরের মাধ্যমে সরাসরি চীন সরকারের হাতে পৌঁছানো হয়। গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগ এবং নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে ইরানে পণ্য সরবরাহ করায় গত বছর ডোনাল্ড ট্রাম্পের এক নির্বাহী আদেশবলে হুয়াওয়ের ওপর বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য বিভাগ। একই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রে কালো তালিকাভুক্ত করা হয়। যুক্তরাষ্ট্র-চীনের বাণিজ্য বিরোধের জেরে ক্রমবর্ধমান একটি প্রতিষ্ঠানের প্রবৃদ্ধি থামিয়ে দেয়ার উদ্যোগ নেয়া হয়। কারণ বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞার কারণে নিজেদের পণ্য উন্নয়নে মার্কিন অংশীদারদের কাছ থেকে হার্ডওয়্যার, সফটওয়্যার ও সেমিকন্ডাক্টর পণ্য কেনা বন্ধ হয়ে যায় হুয়াওয়ের। এছাড়া হুয়াওয়ের পণ্য ক্রয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলোকেও বাধা দেয়া হয়।

হুয়াওয়ের ভবিষ্যৎ কার্যক্রম নিয়ে পশ্চিমা বিশ্বের দেশগুলোর সরকারের যে উদ্বেগ, তা না হয় বাস্তব। তবে যুক্তরাষ্ট্রের সোস্যাল মিডিয়া ও ডিজিটাল প্রতিষ্ঠানগুলোর ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কেন উদাসীন? ফাইভজি অবকাঠামো নির্মাণে হুয়াওয়েকে যুক্ত করা হলে হয়তো ভবিষ্যতে বিপুলসংখ্যক গ্রাহকের তথ্যে প্রতিষ্ঠানটির প্রবেশাধিকার থাকবে এবং এসব তথ্য নিজেদের ব্যবসার স্বার্থে তারা ব্যবহারের সুযোগ পাবে। কিন্তু ফেসবুক ও গুগলের মতো মার্কিন প্রযুক্তি জায়ান্টগুলো তো এখনই গ্রাহকতথ্য নিজেদের খুশিমতো কাজে ব্যবহার করছে। এমনকি নিজেদের গ্রাহক তথ্যে তৃতীয় পক্ষের অংশীদারদেরও প্রবেশাধিকার দিচ্ছে ফেসবুক ও গুগলের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো। এটি স্পষ্ট হয় ফেসবুক এবং রাজনৈতিক তথ্য বিশ্লেষক ও পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ক্যামব্রিজ অ্যানালিটিকা তথ্য কেলেঙ্কারি প্রকাশের পর।

বিশ্লেষকদের ভাষ্যে, টেলিকম সরঞ্জামের নিরাপত্তা ত্রুটি বা ব্যাকডোর নয়; বড় সমস্যা হলো টিকটক, উইচ্যাট ও হুয়াওয়ে চীনভিত্তিক প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান। এসব প্রতিষ্ঠান যার যার ব্যবসা খাতে মার্কিন প্রতিদ্বন্দ্বীদের তীব্র চাপে ফেলেছে। এরই মধ্যে বৈশ্বিক স্মার্টফোন বাজারে প্রযুক্তি জায়ান্ট অ্যাপলকে পেছনে ফেলেছে প্রতিষ্ঠানটি। ফাইভজি প্রযুক্তি উন্নয়ন এবং বাণিজ্যিক ব্যবহার শুরুর ক্ষেত্রেও এগিয়ে রয়েছে হুয়াওয়ে। তবে যে উদ্দেশ্যেই হোক, ফাইভজি প্রকল্প থেকে হুয়াওয়ের পণ্য বর্জন করে কয়েক ধাপ পিছিয়ে পড়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও দেশটির কয়েকটি মিত্র দেশ। অথচ এ প্রযুক্তি বৈশ্বিক টেলিযোগাযোগ খাতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনবে বলে মনে করা হয়।

0Shares

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *