এক বছরে বৈদ্যুতিক কেবলের দাম বেড়েছে ৪০ শতাংশ

বিশ্বব্যাপী ইস্পাতসহ বিভিন্ন কাঁচামালের দাম প্রায় এক বছরের বেশি সময় ধরে ঊর্ধ্বমুখী। কাঁচামালের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধিসহ জাহাজীকরণ খরচ বেড়ে যাওয়ায় দেশে কেবলের দাম বেড়েছে এক বছরে ৪০ শতাংশ। যার প্রভাব পড়েছে দেশের নির্মাণ ও অবকাঠামো খাতে।

২০২০ সালের শেষ দিকে বিশ্ববাজারে বৈদ্যুতিক কেবল তৈরির প্রধান কাঁচামাল কপারের টনপ্রতি বুকিং ছিল মাত্র ৫ হাজার থেকে ৫ হাজার ৫০০ ডলার। ধাপে ধাপে দাম বেড়ে কপারের বর্তমান বুকিং দর টনপ্রতি ৯ হাজার ৭০০ থেকে ৯ হাজার ৮০০ ডলারে উঠে গেছে। ফলে দেশীয় কোম্পানিগুলো তাদের উৎপাদিত কেবলের দাম বাড়িয়েছে ৩৫ থেকে ৪০ শতাংশ। উপর্যুপরি কপারের দাম বেড়ে যাওয়ায় দেশের বাজারে কেবলের দাম আরো বাড়তে পারে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেছে উৎপাদকরা।

দেশের শীর্ষস্থানীয় কেবল উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছরেই দেশের কোম্পানিগুলো কেবলের মূল্য তিন দফায় বাড়িয়েছে। এর পরও কাঁচামালের দাম বেড়ে যাওয়ায় কোম্পানিগুলো আবারো কেবলের মূল্য বাড়ানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে। নতুন মূল্যহার বাস্তবায়ন হলে কেবলের এক বছরের ব্যবধানে মূল্যবৃদ্ধির হার ৫০ শতাংশ ছাড়িয়ে যাবে। তাছাড়া চলতি নির্মাণ মৌসুম শুরু হওয়ার পর কেবলের চাহিদা বেড়ে যাওয়ার কথা থাকলেও বাড়তি দামের কারণে আগের বছরগুলোর তুলনায় এ বছর বিক্রি কমে গেছে আশঙ্কাজনক হারে। যার কারণে পণ্য উৎপাদন সত্ত্বেও দেশের বিভিন্ন কোম্পানির গুদামে উৎপাদিত কেবলের মজুদ বেড়ে যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন কোম্পানির বিপণন বিভাগের কর্মকর্তারা।

দেশে বৈদ্যুতিক কেবলের বাজার প্রায় ৮ থেকে ৯ হাজার কোটি টাকার। ছোট-বড় মিলিয়ে ২০টি কোম্পানি দেশে কেবল পণ্য উৎপাদন করে। দেশে বৈদ্যুতিক কেবলের বাজার শেয়ারে শীর্ষে রয়েছে কুষ্টিয়াভিত্তিক প্রতিষ্ঠান বিআরবি কেবল। দেশের বাজারে বৈদ্যুতিক কেবলের ৪০ থেকে ৪৫ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করে প্রতিষ্ঠানটি। বিবিএস কেবল, আরএফএলের বিজলি কেবল, পারটেক্স ৎকেবল ও রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান ইস্টার্ন কেবল বৈদ্যুতিক কেবলের বাজারে শীর্ষ পাঁচে রয়েছে। এছাড়াও ওয়ালটন কেবল, পলি কেবল, সুপার সাইন কেবল, এমইপি কেবল, প্যারাডাইন কেবল, আর আর কেবল (ভারতীয় প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যৌথ বিনিয়োগ), এসকিউ কেবল দেশের কেবল পণ্য উৎপাদনের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে। অপরদিকে বাংলাদেশ ইস্পাত ও প্রকৌশল করপোরেশনের আরেক প্রতিষ্ঠান গাজী ওয়্যারস বিভিন্ন গ্রেডের কপার ওয়্যার উৎপাদনের সঙ্গে যুক্ত। প্রায় সবগুলো প্রতিষ্ঠানই কপারের বৈশ্বিক মূল্যবৃদ্ধির কারণে উৎপাদন ও বিপণন সংকটের কবলে পড়েছে এক বছর ধরে।

জানতে চাইলে গাজী ওয়্যারসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী সাব্বির আওয়াল বণিক বার্তাকে বলেন, বিশ্ববাজারে কপার পণ্যের দাম এক বছরের মধ্যে প্রায় দ্বিগুণ বেড়েছে। যার কারণে উৎপাদিত কেবলের দামও বাড়ানো ছাড়া উপায় ছিল না। গাজী ওয়্যারস এ বছরের মধ্যে দুই দফায় ফেব্রুয়ারি ও জুলাইয়ে দাম বাড়ানো হয়েছে। মূল্যবৃদ্ধির কারণে সরকারি প্রতিষ্ঠান হওয়ায় অনেক গ্রাহকও হারিয়েছি আমরা। বর্তমানে প্রতিযোগিতামূলক বাজারে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে সমন্বয় করে কীভাবে দাম সহনীয় পর্যায়ে রাখা যায়, সেটার পরিকল্পনা করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন তিনি।

জানা গেছে, দেশের শীর্ষ কেবল উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান চলতি বছরে তিন দফায় কেবলের দাম বাড়িয়েছে। এর মধ্যে চলতি বছরের ১১ মার্চ, ১৭ মার্চ এবং সর্বশেষ ২২ নভেম্বর কেবলের মূল্য বাড়ে। বিশ্ববাজারে কপার কাঁচামালের টনপ্রতি ১০ হাজার ডলারের কাছাকাছি পৌঁছে যাওয়ায় বিদ্যমান মূল্যেও লোকসানের কবলে পড়তে হচ্ছে প্রতিষ্ঠানটিকে। কপারের দাম আরো বাড়লে নতুন করে দাম সমন্বয় করা ছাড়া উপায় থাকবে না বলে জানিয়েছেন প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারা।

এদিকে কেবলের বাজারে সবচেয়ে বেশি সংকটে রয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত দুটি প্রতিষ্ঠান ইস্টার্ন কেবলস ও গাজী ওয়্যারস। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো সুবিধাজনক সময়ে প্রি-অর্ডারের মাধ্যমে কাঁচামাল সংগ্রহ করলেও সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো পণ্য বিক্রির কার্যাদেশ পাওয়ার পর কাঁচামাল আমদানির জন্য ঋণপত্র (এলসি) ওপেন করে। যার কারণে কাঁচামালের দাম বাড়লে লোকসানে হলেও পণ্য সরবরাহ করতে হয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে। এদিকে, উৎপাদন খরচ বেশি হওয়ায় সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো সুলভ মূল্যে কেবল সরবরাহ দিতে ব্যর্থ হচ্ছে। ফলে এসব প্রতিষ্ঠান দ্রুত ক্রেতা হারাচ্ছে বলে মনে করছেন কোম্পানি দুটির কর্মকর্তারা।

খাতসংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, কাঁচামালের মূল্যবৃদ্ধি ছাড়াও বিশ্ববাজার থেকে আমদানি করা পণ্য দেশে আনতে সময়ক্ষেপণ হচ্ছে। শিপিং চার্জ বেড়ে যাওয়ার কারণে কাঁচামালের দামে এর প্রভাব পড়েছে। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কাঁচামাল আমদানি করতে না পারায় ব্যাংকঋণের দায় পরিশোধে বিলম্বে আমদানি খরচ বেড়েছে। এতে পণ্যের উৎপাদন খরচের ওপর বড় ধরনের প্রভাব পড়ছে।

0Shares

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *